অভিনব কৌশলে ১৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ
একটি হত্যা চেষ্টার মামলার তদন্ত ও আসামিকে গ্রেফতার করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ১৫ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। সরকারি জমি বন্ধক রেখে একটি ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুই দফায় এ ঋণ দেওয়া হয়।
তবে সেটি ধরা পড়ার পর আবার সংশোধন দলিল করেন। এবার আগের বন্ধককৃত জমির দাগ নম্বর পরিবর্তন করে ব্যাংকে জমা দেন। সংশোধিত দলিলের জমিতে বন্ধকি সম্পত্তির সাইনবোর্ড স্থাপনের চেষ্টা করলে ব্যাংক জানতে পারে সেটিও ভুয়া।
সংশোধিত দলিলের জমির আসল মালিক জামির আলী। ২৭ শতাংশ ওই জমি দখলে নিতে একাধিকবার তার ওপর হামলা ও হত্যা চেষ্টা চলে। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জানালেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে র্যাব-১ এর একটি দল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে অভিযুক্ত গোলাম ফারুক (৫০) ও তার সহযোগী ফিরোজ আল মামুনকে (৩৫) গ্রেফতার করে।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বাড্ডা থানাধীন মেরুল বাড্ডা এলাকায় জাল দলিল সংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি হত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটে। যেখানে ভিকটিমকে নিজ জমি থেকে জোরপূর্বক উৎখাত করার চেষ্টা করা হয়। এ উদ্দেশ্যে গোলাম ফারুক ও তার সহযোগী ফিরোজ আল মামুনসহ অন্যান্যরা গত ২৬ মার্চ ও ৬ এপ্রিল জামির আলীকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেন।
ওই ঘটনায় ভিকটিম আদালতে একটি নালিশি দরখাস্ত করলে আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে বাড্ডা থানাকে এটিকে এফআইআর হিসেবে গণ্য করার আদেশ দেন। এরপর এ বিষয়ে বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়। ওই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র্যাব। বৃহস্পতিবার রাতে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ এবং হত্যা চেষ্টা মামলার প্রধান আসামি গোলাম ফারুক ও ফিরোজ আল মামুনকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজধানীর বাড্ডায় হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেছেন। মহাসড়কের জমি ক্রয়-বিক্রয় ও প্রতারণামূলকভাবে ব্যাংকে বন্ধক রেখে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর তথ্যও দেন তারা।
২০২১ সালের এপ্রিলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মহাসড়কের জমি ব্যক্তি নামে নিবন্ধন, বিক্রয়, ব্যাংকে বন্ধক ও ব্যাংক কর্তৃক নিলামে বিক্রি চেষ্টার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। ওই ঘটনায় ভূমি মন্ত্রণালয় তদন্তপর্ষদ গঠন করে। তদন্তে একটি প্রতারক চক্র মহাসড়ক শ্রেণিভুক্ত সরকারি জমি কয়েকটি সরকারি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে ব্যক্তি মালিকানায় নিবন্ধন করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। যদিও এসব জমি সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর কর্তৃক অধিগ্রহণ করা।
গাড়ি আমদানি ব্যবসা করতে গিয়ে প্রতারণা শুরু
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার গোলাম ফারুক জানান, তিনি ২০০০ সাল হতে গাড়ি আমদানিকারক হিসেবে ব্যবসা শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কোনো বন্ধকি সম্পত্তি ব্যতীত এলসি আবেদন করে গাড়ি আমদানি শুরু করেন। বিদেশি ব্যাংকের টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায় বেসরকারি ব্যাংকটি আমদানি করা গাড়ি বিক্রি করে অর্থ পরিশোধ করার শর্তে তাকে সাত কোটি টাকা ডিমান্ড লোন দেয়। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক তাকে সম্পত্তি বন্ধক দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করলে তিনি সরকারি জমিকে ব্যক্তি নামে নিবন্ধন করার পরিকল্পনা করেন।
অধিগ্রহণ পূর্ব জমির মালিককে খুঁজে নামমাত্র মূল্যে ক্রয়
১৯৪৮ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরার আজমপুর অংশের অধিগ্রহণ হওয়ার আগের জমির মালিকের ছেলেকে খুঁজে বের করেন অভিযুক্ত ব্যক্তি। জালিয়াতির সাহায্যে তিনি ২০০৬ সালে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি ভুয়া দলিল তৈরি করেন। পরে ওই দলিলমূলে তৎকালীন মালিকের ছেলের নিকট হতে গ্রেফতার গোলাম ফারুক তার স্ত্রীর নামে ২০১০ সালে মাত্র ৩০ হাজার টাকায় ক্রয় করে আরেকটি দলিল তৈরি করেন। একই বছরে তার স্ত্রী হতে ওই জমি নিজের নামে দলিল করে নেন। যার সাফ কবলা দলিল নম্বর ৮৮৮০।
মহাসড়কের জমি নিজের দেখিয়ে ব্যাংক লোন
জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল ও মহাসড়কের জমিকে নিজের বলে দেখিয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে বন্ধক দেখান। এজন্য তিনি আরও ১৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেন। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৩ সালে ব্যাংক অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে বন্ধকি জমি নিলামে বিক্রি করার নোটিশ জারি করলে ব্যাংক সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পায় ওই জমিটি সরকারি সম্পত্তি।
পরে তিনি ভুল সংশোধন দলিল করে পূর্বের বন্ধককৃত জমির দাগ নম্বর পরিবর্তন করে দেন। এক্ষেত্রে তিনি মামলার বাদীর ও ভুক্তভোগী জামির আলীর জমির দাগ নম্বর উল্লেখ করেন। তখন ব্যাংক সেই জমিতে বন্ধকি সম্পত্তির সাইনবোর্ড স্থাপন করতে গিয়ে জানতে পারে সেটিও ভুয়া।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে জমি সংক্রান্ত, প্রতারণা, হত্যা চেষ্টা, এনআই অ্যাক্ট, জালিয়াতির অপরাধে রাজউক কর্তৃক একটি, বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চারটি ও পাবলিক বাদী হয়ে ৩টিসহ মোট ৮টি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতার ফিরোজ আল মামুন গোলাম ফারুকের সব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী। তিনি উত্তরা এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ বিস্তারে কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
মামলার বাদী ও ভুক্তভুগী জামির আলী বলেন, আমার উত্তরার ২৭ শতাংশ জমি গ্রেফতার ফারুক দখল করার চেষ্টা করছিলেন। তাদের কাছে ওই জমির কোনো দাগ খতিয়ান নেই। এছাড়াও ওই জায়গা বন্ধক দিয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে ১৫ কোটি টাকা লোন নেন। যা আমার অনুপস্থিতিতে আমার ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে অভিযোগ করলে তারা ব্যবস্থা নেননি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত