অর্থ বিভাগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিপত্র জারি
অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে কৃচ্ছ্র সাধনের পরিধি বাড়লো। বিদ্যুতের পাশাপাশি এবার জ্বালানিখাতে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরলো সরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কোম্পানিগুলো এখন থেকে জ্বালানি খরচের সর্ব্বোচ্চ ৮০ ভাগ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবে। আর বিদ্যুত খাতের বরাদ্দের ২৫ ভাগ সাশ্রয় করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) বিকালে অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা এক পরিপত্রে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। এতে করে সরকারের বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ বেঁচে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধুমাত্র জ্বালানিখাতে বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, এর আগে এ মাসে কৃচ্ছ্র সাধনের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে আরও দুটি পরিপত্রে জারি করা হয়েছিল। এর একটি হচ্ছে, এ মাসে তারিখে জারি করা‘ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কতিপয় ব্যয় স্থগিত-হ্রাসকরণ’ এবং অপরটি হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সন্মানি বাবদ ব্যয় স্থগিতকরণ।’
এদিকে, অর্থমন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগ থেকে জারি করা পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে,‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয় কৃচ্ছ্র সাধন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়াত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সরকার তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
সিদ্ধান্তে মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে,‘ ৩২৪৩১০১ (কোড)-পেট্রোল, ওয়েল(অকটেন) ও লুব্রিকেন্ট ও ‘৩২৪৩১০১-গ্যাস ও জ্বালানি’-খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্ব্বোচ্চ ৮০ভাগ ব্যয় করা যাবে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে-‘বিদ্যুৎখাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ২৫ ভাগ সাশ্রয় করতে হবে। এবং তৃতীয় সিদ্ধান্ত মধ্যে রয়েছে,‘এইখাত সমূহে বরাদ্দকৃত অর্থ অন্যকোনো খাতে পুনঃউপযোজন করা যাবে না।’ অর্থ্যাৎ বেচে যাওয়া অর্থ অন্যকোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানান, পেট্রোল, ওয়েল ও লুব্রিকেন্ট ও গ্যাস ও জ্বালানিখাতেন দুটি কোডে চলতি অর্থবছরে বাজেটে দুইহাজার ৪২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ ভাগ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলে সরকারের অর্থ বাঁচবে ৪৯৩ কোটি টাকা। আর বিদ্যুৎখাতে ২০ভাগ খরচ কমানো গেলে আরও কয়েকগুণ অর্থ বাঁচানো যাবে। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্ত কতখানি পরিপালন করা সম্ভব হবে তা বছর শেষেই বলা যাবে।
এদিকে, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছসাধন করে গত দুই অর্থবছরে ২৯ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সাশ্রয় হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা । এবং সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে খরচ কমানো গেছে ৪ হাজার কোটি টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সরকারি বাহুল্য ব্যয় কমানো জন্য গাড়ি কেনা বন্ধ, সরকারি কর্মকর্তাদের সন্মানী ভাতা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সাথে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ছাড়ও বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছেন, কোভিডকালীন সময় গত দুই অর্থবছর থেকে সরকার কৃচ্ছসাধণের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে সরকারি প্রকল্পে গাড়ি ক্রয়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়া অন্যতম। এই উদ্যোগের ফলে প্রথম বছরে বেশ ভালো পরিমান অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। যার পরিমান ছিল প্রায় ২৫হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত অর্থবছরে কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য কৃচ্ছ সাধণের নীতি থেকে কিছু পিছু হটা হয়েছিল। বন্ধ থাকা অনেক প্রকল্পে অর্থ ছাড়ও করা হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ফলে গেল অর্থবছরে অর্থ সাশ্রয়ের পরিমান ছিল বেশ কম, প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এবার গাড়ি কেনা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় বন্ধ করাসহ নতুন করে আরও একটি বিষয় যোগ করা হয়েছে। আর সেটি হলো, কর্মকর্তারা বিভিন্ন বৈঠকে যোগদান করে যে সন্মানী ভাতা পান তাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে চলতি অর্থবছরে বেশ ভালো পরিমান অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ মাসে অর্থ বিভাগ থেকে কৃচ্ছ সাধণের জন্য মোট তিনটি পরিপত্র জারি করা হয়। এগুলোর মধ্যে‘উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পসমূহের অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন’ শীর্ষক পরিপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে, সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলো ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং অধীন দপ্তর/সংস্থাগুলো ‘এ’ ক্যাটাগরি চিহ্নিত প্রকল্পের বাস্তবায়ন যথানিয়মে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলবে। ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি (জিওবি) অংশের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত রেখে অনূর্ধ্ব ৭৫ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড় আপাতত স্থগিত থাকবে। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুসারে ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ করা অর্থ আবার যোগ করে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ বিভাগের পূর্বানুমতি গ্রহণপূর্বক) ‘এ’ ক্যাটাগরি চিহ্নিত প্রকল্পগুলোতে ব্যয় করতে পারবে।
এ পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ অবমুক্তি ও ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৮-সহ বিদ্যমান আর্থিক বিধিবিধান ও নিয়মাচার যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।’
‘পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কতিপয় ব্যয় স্থগিত বা হ্রাসকরণ’ শিরোনামের পরিপত্রে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে কিছু খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয়ে সব ধরনের যানবাহন কেনা (মোটরযান, জলযান ও আকাশযান) বন্ধ থাকবে। শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় আপ্যায়ন ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, অন্যান্য মনিহারি, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র খাতে বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। দেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খাতে (প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত) বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। এসব খাতে বরাদ্দ করা অর্থ অন্য কোনো খাতে যোগ করা যাবে না।
‘উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী বাবদ ব্যয় স্থগিতকরণ’ শীর্ষক আরেক পরিপত্রে বলা হয়েছে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বাজেট ও নিজস্ব তহবিলের আওতায় বাস্তবায়নাধীন সব ধরনের প্রকল্প/কর্মসূচি/স্কিমসমূহের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি), প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি), বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিপিইসি), বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (এসপিইসি) এবং বিভাগীয় বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিএসপিইসি) সভায় সম্মানী বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত