অসংখ্যা নারী জরায়ু-স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত, বছরে মৃত্যু ১৪ হাজার
মিরপুর পল্লবীর বাসিন্দা শিউলি আক্তার জুঁই (৪৫)। স্বামী ওয়াসিম সাজ্জাদ মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। এখন একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পল্লবীতেই থাকেন শিউলি। অভাবের সংসারে কোনো রকম কেটে যাচ্ছিল দিন। এর মধ্যেই তিন বছর আগে জরায়ু মুখে ক্যানসার শনাক্ত হয়। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে দুই লাখ টাকা খরচে করানো হয় অপারেশন। এছাড়া ভারতের ভেলোরেও দুই লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে চিকিৎসার জন্য। এখন কেমোথেরাপি দিতে হয় প্রতি ছয় মাস পরপর। প্রতিটি কেমোতে খরচ হয় আট হাজার টাকা। এছাড়া ওষুধ ও অন্যান্য পরীক্ষা তো আছেই।
বলা যায় এক ক্যানসার পথে বসিয়েছে শিউলি আক্তারকে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি যেন পড়েছেন অথৈ সাগরে। শিউলি আক্তারের মতো নারীর সংখ্যা দেশে হাজার হাজার। এছাড়া একইভাবে নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন স্তন ক্যানসারে। এ দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে নারীদের মৃত্যুও বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, স্তন ও জরায়ু মুখ ক্যানসারের কারণে বছরে প্রায় ১৪ হাজার নারী প্রাণ হারাচ্ছেন। এ সংখ্যা মাতৃমৃত্যুর চেয়েও বেশি।
এ অবস্থায় এ দুই ধরনের ক্যানসার থেকে নারীদের বাঁচাতে চলমান প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ বাড়িয়ে দুইশ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ‘ইলেকট্রিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং’ কর্মসূচির আওতায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি চালুর লক্ষ্যে প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে এই প্রস্তাবনা গেছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য উইং) ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন বলেন, প্রকল্পটি বর্তমানে চলমান। স্তন-জরায়ু মুখ ক্যানসার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এ দুটি ক্যানসার থেকে নারীদের পরিত্রাণ দিতেই প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়ছে। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) আমাদের হাতে এসেছে। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর পরে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা হবে। সেখানে অনুমোদনের পর একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ১১ হাজার ৯৫৬ জন নারীর জরায়ু মুখ ক্যানসার শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে মারা যান ৬ হাজার ৫৮২ জন। একইভাবে ১৪ হাজার ৮৩৬ জন নারীর স্তন ক্যানসার শনাক্ত হয় এবং ৭ হাজার ১৪২ জন মারা যান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) জানায়, জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের পাঁচ বছর বেঁচে থাকা নির্ভর করে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও কার্যকরী চিকিৎসার উপর। এ কারণে এই ক্যানসার দুটির প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হওয়া পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক নীতি কাঠামো অনুযায়ী, জরায়ু মুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ের কর্মপন্থা ‘জনসংখ্যাভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম’ হতে হবে। এ সংক্রান্ত সেবা সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এটি একটি সর্বজনীন কর্মপন্থায় পরিচালিত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে ‘ইলেক্ট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ত্রিনিং প্রোগ্রাম’ গড়ে তোলা সরকারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ক্যানসারের দুটি স্ক্রিনিংয়ের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএসএমএমইউ’র মাধ্যমে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৪৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরে প্রথম সংশোধনে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৫৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা হয়। দ্বিতীয় সংশোধনে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করা হচ্ছে।
বিএমএমএসইউ সূত্র জানায়, সবগুলো উদ্দেশ্য সামগ্রিকভাবে বাস্তবায়নের কারণেই প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং, ব্যবস্থাপনা এবং ফলোআপের জন্য কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে ক্যানসারজনিত মৃত্যুহার কমানো হবে। দেশের সব জেলায় এই স্ক্রিনিং সেবা চালু করা হবে। সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নির্বাচিত কমিউনিটি ক্লিনিক, ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচির অবকাঠামো উন্নয়নও করা হবে। এসব কারণে প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ছে।
চলমান প্রকল্পটি জুন, ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল। তবে মেয়াদ বেড়ে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ করা হচ্ছে।
নতুন করে প্রকল্পের আওতায় দুটি ক্যানসার প্রতিরোধে দেশব্যাপী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কমিউনিটি পর্যায় থেকে ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার রোধে গড়ে তোলা হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালে জরায়ু মুখ এবং স্তন ক্যানসার পূর্বাবস্থা চিকিৎসার সুবিধাদি করা হবে শক্তিশালী। রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হবে। এর মাধ্যমে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে ৩৩ হাজার ৫১২ বর্গফুট জায়গায়।
প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবায় জরায়ু মুখ এবং স্তন ক্যানসার রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না হওয়ায় টারশিয়ারি হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে এসব রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এসব রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানে সার্জিক্যাল চিকিৎসা ও রেডিওথেরাপির সুবিধা রয়েছে যা রোগীর সংখ্যার তুলনায় খুবই কম। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে যেসব সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে এ রোগের চিকিৎসা করা তাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে মত দিয়েছে বিএসএমএমইউ।
প্রকল্প সংশোধনের আরও কারণ
প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশের আলোকে ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। সব সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ফ্যাসিলিটি সেবা চালুর পাশাপাশি রেফারেল ব্যবস্থা (রেফারেল পদ্ধতিতে একজন সাধারণ চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠান, একজন বিশেষজ্ঞ অন্য বিশেষজ্ঞের কাছেও রোগী পাঠান। এমনকি এক হাসপাতাল অন্য হাসপাতালেও রোগী পাঠায়) জোরদার করা হবে।
সিভিল সার্জন, তত্ত্বাবধায়ক, অন্যান্য কর্মকর্তাদের মতামত ও চাহিদার ভিত্তিতে রেফারেল কেন্দ্রগুলোর ছোটখাট সংস্কার কাজ কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হবে। এছাড়া কলনোস্কোপি ক্লিনিক, ব্রেস্ট ক্লিনিক এবং ভায়া ও সিবিই স্ক্রিনিং কেন্দ্রে থাই পার্টিশন ও ভৌত সংস্কারসহ অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতালে ব্রেস্ট ক্লিনিক স্থাপন করবে সরকার। স্তন ক্যানসার রোগীদের দেওয়া হবে উন্নত চিকিৎসাসেবা।
প্রকল্পে নতুন খাত অন্তর্ভুক্তি
শিক্ষক, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান, নলেজ শেয়ারিং, গবেষণা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ধারণা নেওয়ার জন্য তিন ব্যাচে ২৪ জনের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা, চাহিদা ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় বিদ্যমান অঙ্গসমূহ ঢেলে সাজানো হবে।
সুপারভিশন ও মনিটরিং, অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ, হেলথ ক্যাম্প, সেমিনার অ্যান্ড কনফারেন্স, মুদ্রণ ও প্রকাশনা, রাসায়নিক দ্রব্যাদি, যানবাহন, চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও গবেষণা এর মধ্যে অন্যতম।
এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দুটি রোগ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অনেক মায়েদের অকালে প্রাণ যাচ্ছে। তবে ক্যানসার প্রতিকারের অন্যতম প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি। আমরা সারাদেশে এ বিষয়ে নানা ধরনের কর্মসূচি নেবো। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দুটি ক্যানসার নিরাময়ের চিকিৎসা উন্নত করবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে (বিএসএমএমইউ) গবেষণা করা হবে রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য। এখন উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে। তবে ভালোর কোনো শেষ নেই। আমরা ক্যানসার গবেষণায় আরও উন্নয়ন করবো।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত