আশা, ধোঁয়াশা
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরেই সরকার চালু করবে- এমন ঘোষণা এসেছে গত ৯ জুনের প্রস্তাবিত বাজেটে। তবে পেনশন কতটা সর্বজনীন হবে, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এটি কবে নাগাদ চালু হবে, সেটারও নেই নিশ্চয়তা। কারণ, সর্বজনীন পেনশন দেশের সব নাগরিক পাবে কিনা, সেটার পথনকশা এখনও তৈরি হয়নি।
বিশ্নেষকরা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি রাষ্ট্রের একটি নিরাপত্তা জালের মতো। তবে সরকার যেটা বলছে, সেটা কন্ট্রিবিউটরি পেনশন; সর্বজনীন নয়। আর সর্বজনীন পেনশন আইন চূড়ান্ত হতে কত দিন সময় লাগবে- এ বিষয়ে কারও স্বচ্ছ ধারণা নেই। আইন তৈরির পর বিধিমালা হবে। এরপর কাটবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ধোঁয়াশা।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, এ বছরই সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করবে। এরই মধ্যে প্রকাশ হয়েছে আইনের খসড়া। এর পর থেকেই পেনশন কতটা সর্বজনীন হবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী আসছে অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন চালুর যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা কল্পনার মতো। অর্থমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টা কাজ করলেও এটা এ বছর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সর্বজনীন পেনশন চালু হতে আরও কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছর, তাঁরা এই পেনশন স্কিম খুলতে পারবেন। ১০ বছর ধারাবাহিকভাবে চাঁদা জমা দেওয়ার পর একজন মাসিক পেনশনের যোগ্য হবেন। পেনশন পাওয়ার বয়সসীমা হবে ৬০ বছর। নিয়মিত চাঁদা জমা না দিলে স্কিম স্থগিত থাকবে এবং জরিমানা ও কিস্তি শোধ করে নিয়মিত করা যাবে। পেনশনের টাকা মাসিক ভিত্তিতে পাবেন, এককালীন তোলার সুযোগ থাকবে না। তবে জমা টাকার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ মিলবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য এ ব্যবস্থা চালু করলে সর্বজনীন সফলতা আসবে না। এটি সর্বজনীন করতে হলে সবাইকে সুবিধার আওতায় আনতে হবে। গরিব-ধনী সবাই যেন অংশ নিতে পারে- এমন নিয়ম রাখতে হবে। এ ছাড়া ফান্ড ব্যবস্থাপনায় সুশাসন ও ঝামেলাহীন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এখনও এই পেনশনের পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। আইন ও বিধিমালা হলে বোঝা যেত কোথায় ত্রুটি আছে, কতটা সুবিধা আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে কোনো নাগরিককেই বাদ দেওয়া যায় না। সেটা সরকার কীভাবে দেবে, তার পলিসি করা প্রয়োজন। সর্বজনীন করতে হলে যাঁদের সুনির্দিষ্ট আয় নেই বা আয় কম, তাঁদেরও এর মধ্যে রাখতে হবে। সর্বোচ্চ বয়সসীমাও থাকা উচিত নয়। আর এটা চূড়ান্ত করার আগে সবার মতামত নেওয়া দরকার। কারণ, এখানে সরকার যে অংশ দেবে, সেখানে নাগরিকদের করের টাকাও থাকবে। তাঁর কথা, এখানে অর্থনীতির কাঠামো, চাপ নেওয়ার ক্ষমতা- এগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।
অর্থ বিভাগের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সর্বজনীন পেনশন প্রথায় থাকছে কন্ট্রিবিউশন ও ডোনেশন সিস্টেম। কন্ট্রিবিউশন প্রথায় যাঁর যত টাকা জমা থাকবে, তাঁর তত বেশি পেনশন সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে আর্থিকভাবে অক্ষমদেরও বিমুখ করবে না এ উদ্যোগ। যাঁরা কোনো টাকা জমাতে পারবেন না, তাঁদের জন্য অনুদান দেবে সরকার।
উন্নত রাষ্ট্রে যেভাবে চলছে সর্বজনীন পেনশন: যে কোনো দেশে যখন সর্বজনীন পেনশন চালু হয়, তখন জনপরিসরে হয় আলাপ-আলোচনা। এরপর সরকার একটা আইনের খসড়া তৈরি করে। সেই খসড়া আইনের ওপর মতামত নেওয়া হয়। সরকার মতামতগুলোর কারিগরি দিক বিবেচনা করে। কারণ, এ জন্য নিয়মিত ফান্ড করতে হয়। তাই একটা টেকসই ব্যবস্থা রাখে। ভারতে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা (এনপিএস) চালু হয়। এ ছাড়া দেশটিতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের জন্য সামাজিক পেনশন ব্যবস্থাও চালু রয়েছে। চীনে তিন ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। শহরে কর্মরতদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস), সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম (সিপিএসপিএস) এবং গ্রামে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিতদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম (আরপিএস) চালু রয়েছে। যুক্তরাজ্যে চালু রয়েছে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড- এই চার ধরনের পেনশন ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড এবং ব্যক্তিগত পেনশন। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া টাকা বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেওয়া হয়।
তবে দেশের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আইনের খসড়া করার সময় কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ১৪ দেশের আইন অনুসরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সব ভালো বিষয় খসড়া আইনে আছে। এখন এর বাস্তবায়ন নির্ভর করছে বিধিমালা তৈরির ওপর। কারণ, আইন একটি কাঠামো মাত্র। এ আইন চূড়ান্ত হতে এখনও অনেক পথ বাকি। আইনে আরও অনেক কিছু যোগ-বিয়োগ হতে পারে।
এ বছর চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা: অর্থ বিভাগ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০২২-এর খসড়া এই মাসের প্রথম সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করবে। মন্ত্রিসভায় আইনটি অনুমোদিত হলে ভ্যাটিংয়ের জন্য সে?টি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যাবে। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর উঠবে জাতীয় সংসদে। সংসদে অনুমোদনের পর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করবে অর্থ বিভাগ। এরপর আইন অনুসারে বিধিমালা তৈরির কাজ শুরু হবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন ও বিধিমালার কাজ শেষ করতে কত দিন লাগবে- এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারেননি।
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রবিধি) মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, এ আইন কবে চূড়ান্ত হবে, সে বিষয়ে কিছুই জানি না। আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে সুবিধাভোগীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, আলোচনা করা বা না করা সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, এ আইনের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিগগির মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হব।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) প্রধান নির্বাহী ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জন্য প্রাথমিক তহবিল কোথা থেকে সংস্থান করা হবে- সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কেমন হবে, পেনশন কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব কী হবে, কার্যপ্রণালি কেমন হবে, নূ্যনতম প্রিমিয়াম হার কত হবে, তহবিল ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, কীভাবে এবং কোথায় পেনশন তহবিল বিনিয়োগ হবে, লভ্যাংশ কীভাবে বণ্টন করা হবে- সেগুলো নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। সরকার দেবে কিনা, গরিবদের জন্য কী ব্যবস্থা থাকবে এগুলো স্পষ্ট করতে হবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত