ইভ্যালির পরিচালনা বোর্ডের প্রতিবেদন প্রকাশ, বেড়িয়ে এলো নতুন তথ্য
আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও ডিসকাউন্টের চাকচিক্যে কোনরকম আইন না মেনেই গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। ইভ্যালিকে নিয়ে অডিট রিপোর্ট এবং আদালতের নির্দেশে গঠিত পরিচালনা বোর্ডের প্রতিবেদনে এমন তথ্য ওঠে এসেছে। এসব রিপোর্টে কোম্পানিটির দুরবস্থার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলকে দায়ী করা হয়েছে। একইসঙ্গে জানানো হয়েছে, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেনের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, এই টাকাগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে।’
মূলত ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইভ্যালিতে অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করা নিয়ে গ্রাহকদের মনে সন্দেহ দানাবাঁধতে থাকে। এক পর্যায়ে মোটরসাইকেল-ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিনসহ বেশকিছু দামি পণ্য সরবরাহ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যারহাউজে গ্রাহকরা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাদের মধ্যে আরিফ বাকের এমনই একজন গ্রাহক। গুলশান থানায় অর্থ আত্মসাৎ ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে তিনি মামলা করেন। ওই মামলায় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসায় অভিযান পরিচালনা শেষে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রতিষ্ঠানটির মূল মালিক ও পরিচালকরা গ্রেফতার হওয়ার পর ইভ্যালি থেকে পাওনা আদায় ও ইভ্যালির অবসায়ন চেয়ে হাইকোর্টে একের পর এক আবেদন আসতে শুরু করে। কিন্তু কোম্পানির গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের প্রচেষ্টায় ইভ্যালি পরিচালনায় নতুন এক বোর্ড গঠন করেন হাইকোর্ট। বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তার সঙ্গে পরিচালনা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন- অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. রেজাউল আহসান (স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগ), চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে ফখরুদ্দিন আহমেদ ও আইনজীবী হিসেবে খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ এবং সরকারি বেতনে এক্স-অফিসিও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে অতিরিক্ত সচিব (ওএসডি) মাহবুব কবির।
তবে ইভ্যালির সঠিক কোনও আয়-ব্যয়ের হিসাব না থাকায় এবং তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটাই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় আদালতের নির্দেশ গঠিত পরিচালনা বোর্ড। এ অবস্থায় কোম্পানিটির সকল হিসাব অডিট করা হয়।
পাশাপাশি গত ৬ এপ্রিল জামিনে কারামুক্তির পর ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় চালু করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশে গঠিত বোর্ডের কাছে আবেদন করেন। ওই আবেদনে শামীমা নাসরিন ও তার মা এবং বোনের স্বামীকে পরিচালনা বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানানো হয়।
এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে শামীমা নাসরিনের আবেদনটি গ্রহণ করে গঠিত পরিচালনা বোর্ড। একইসঙ্গে পদত্যাগের সুযোগ থাকায় হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত বোর্ড প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বভার ছেড়ে দেন। পরে বোর্ডের সদস্যরা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে তাদের মতামত ও অডিট রিপোর্ট হাইকোর্টে উপস্থাপন করেন। সেসব প্রতিবেদনে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটির দুরবস্থার যাবতীয় চিত্র।
প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের টাকা নিয়ে প্রতারণা করার উদ্দেশেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির জন্ম হয়েছিল। ইভ্যালি ছিল এক পরিবারের কোম্পানি এবং একক ব্যক্তির নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটি চলতো। এই প্রতিষ্ঠানে মোহাম্মদ রাসেলই একাধারে এমডি, সিইও, সিএফও, প্রধান হিসাব রক্ষকসহ সব দায়িত্ব পালন করতেন। ব্যবসা পরিচালনায় কোম্পানিটি কোনও আইন ও বিধি মানেনি। সবক্ষেত্রেই ছিল গোঁজামিল। অনেক ভাউচার পাওয়া গেলেও দাতা-গ্রহীতার কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। ফলে কোম্পানির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছিল, কোম্পানি চালানো সম্ভব না হলে দেউলিয়া করে দেয়া, কিন্তু পরিচালনা বোর্ডের মতে, লাখ লাখ গ্রাহকের ভাগ্য ও পুঁজি এই কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তাই দেউলিয়া ঘোষণা না করাই সমীচীন। এর ফলে ইভ্যালি ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে চালুর হওয়ার পথ খোলা থাকবে। ২০২১ সালের ১ জুলাইয়ের আগে সকল গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ কিংবা তাদের চাহিদা মতো পণ্য ডেলিভারিসহ ব্যবসা বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত সকল মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করা প্রয়োজন। সাভারে অবস্থিত ইত্যাদির ৪টি গোডাউনে বাজার মূল্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে। যার বেশিরভাগই হচ্ছে ইলেক্ট্রনিকস পণ্য সামগ্রী। এগুলো এভাবে পড়ে থাকলে প্রায় সবগুলো পণ্য নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এরমধ্যেই পচনশীল সব দ্রব্যের মেয়াদ পার হয়ে গিয়েছে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
‘ইভ্যালি ছিল দেশের সবচেয়ে বড় গ্রাহক বেইজ প্রতিষ্ঠান। সার্ভার চালু করা এবং গ্রাহকের সমস্ত তথ্য পাওয়া গেলে এস্ক্রো এবং ওয়্যারহাউজের সকল বিস্তারিত তথ্যাবলী পাওয়া যাবে। ওয়্যারহাউজে আছে প্রায় ২৫ কোটি টাকার মালামাল। এস্ক্রোতে আছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। এস্ক্রোর টাকার মধ্যে যেমন আছে গ্রাহকের টাকা, তেমন ইভ্যালির টাকাও আছে সেখানে। অর্থাৎ, যেসব মালামাল ডেলিভারি হয়ে গেছে, গ্রাহকের সে টাকা ইভ্যালি পাবে।’
ইভ্যালির লেনদেনসহ সার্বিক তথ্য তুলে আনতে কোম্পানিটির অডিট প্রতিবেদনে বেশ কিছু অনিয়মের তথ্য ওঠে এসেছে। সেই রিপোর্টের আলোকে বিদায়ী পরিচালনা পর্ষদের পর্যবেক্ষণ ছিলো এমন—‘অডিট রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্যাবলী এবং কাগজপত্রের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এইভাবে ব্যবসা পুনরায় চালানো অসম্ভব, যদি সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে দূর করে ব্যবসা চালানো না হয়। ইভ্যালির বিশাল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কোনও স্তরেই কোনও প্রকার জবাবদিহি বা স্বচ্ছতা ছিল না। যেটা একটা সফল ম্যানেজমেন্টের মূল স্তম্ভ। অডিট রিপোর্টে কোম্পানির আর্থিক অবস্থান চিহ্নিত করার মতো কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি বা ইভ্যালির প্রাক্তন ম্যানেজমেন্ট তা মেইনটেইন করেনি।
অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে, হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেনের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, এই টাকাগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্নের উদ্রেক করে। যা ছিল এই কোম্পানির সবচেয়ে বড় অনিয়ম।’
প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় চালু করাটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে সাবেক পরিচালনা পর্ষদ। এ বিষয়ে তারা বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ‘ইভ্যালির ব্যবসা পুনরায় চালু করার জন্য অবশ্যই নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে বা দেশি/বিদেশি বিনিয়োগকারী আনতে হবে। ইভ্যালির সমস্ত ডাটা সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই লোকাল সার্ভার ব্যাক-আপ হিসেবে রাখতে হবে। বাহুল্য খরচ আপাতত তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার এবং সর্বনিম্ন লোকবল দিয়ে সর্বোচ্চ কাজ করিয়ে নিতে হবে। প্রতিটি খরচের হিসেব রাখতে হবে যথাযথভাবে।’
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত