একটি পাবলিক টয়লেটের পেছনে খরচ ৪৫ লাখ টাকা
উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনাসহ নানামুখী উদ্যোগ তেমন কাজে আসছে না। এ ধরনের প্রকল্পে লাগামহীন ব্যয়ের প্রস্তাব অব্যাহত আছে। পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগার নির্মাণে একক ব্যয় (৫টি টয়লেট মিলে একটি) প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে শুধু একেকটি টয়লেটের পেছনে ব্যয় হবে ৯ লাখ টাকা করে।
এভাবে ৭টি এ টাইপের পাবলিক টয়লেট তৈরিতে চাওয়া হয়েছে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া ৬টি বি টাইপ পাবলিক টয়লেটের জন্য চাওয়া হয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ফলে প্রতিটির একক মূল্য দাঁড়ায় ৪০ লাখ টাকা করে। সেই সঙ্গে কয়েকটি কাজের জন্য অত্যধিক পরামর্শক ব্যয়ের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের নামে কৌশলে বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে বিদেশ ভ্রমণ বাদ দেওয়া হচ্ছে। ‘খুলনা সিটি করপোরেশনের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে এসব ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। গত ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায়। ওই সভায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। খবর পরিকল্পনা কমিশন সূত্রের।
প্রসঙ্গত গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অবস্থায় গণশৌচাগার নির্মাণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তিন ক্যাটাগরির প্রকল্প ব্যয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আলোচ্য প্রকল্পটি কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে তা পরীক্ষা করে দেখার কথাও বলেন সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অপচয় বন্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এ বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। ফলে আগের মতো ঢালাওভাবে লাগামহীন ব্যয় প্রস্তাব আসছে না।
তবে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়নি। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা (সচিব) এখন অনেক সতর্ক আছেন। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সুপারিশ দিচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিইসি সভাগুলোতে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী থাকার সুযোগ থাকলে আরও ভালো হতো। এক সময় আমি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
কিন্তু তিনি পরে আর বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেননি। ফলে এখন সদস্যরা প্রকল্প চূড়ান্ত করে একনেকে উপস্থাপনের জন্য আমার কাছে নিয়ে আসেন। তখন খুব বেশি ভেতরে গিয়ে দেখার সুযোগ থাকে না। এরপরও অপচয় বন্ধের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ প্রসঙ্গে কথা হয় পিইসি সভার সভাপতি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মামুন-আল-রশীদের সঙ্গে।
মঙ্গবার তিনি বলেন, প্রকল্পটিতে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু পিইসি সভায় সেসব ব্যয় কমিয়ে আনার সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ৫টি করে টয়লেট একত্রে তৈরির জন্য ১৭০০ বর্গফুট জায়গার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা বলেছি, জায়গার পরিধি কমাতে হবে। সেই সঙ্গে সার্বিকভাবে এ খাতের ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ মিলে চাওয়া হয়েছিল ৮২ লাখ টাকা। আমরা সব ধরনের প্রশিক্ষণই বাতিল করতে বলেছি।
সূত্র জানায়, ‘খুলনা সিটি করপোরেশনের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১২০০ কোটি এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)।
পিইসি সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ৬টি হেড-এ পাবলিক হল কমপ্লেক্স, ওয়ার্ড অফিস কাম কমিউনিটি সেন্টার এবং কসাইখানার জন্য পরামর্শক ব্যয় হিসাবে ১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা রাখা হয়েছে।
কিন্তু পরামর্শকদের টিওআর (টার্ম অব রেফারেন্স) ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) দেওয়া হয়নি। এছাড়া অল্প কয়েকটি কাজের জন্য এত টাকা পরামর্শক ব্যয় অত্যধিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে।ফলে পিইসি সভায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পে দ্বিতীয়তলা ওয়ার্ড অফিস নির্মাণে প্রতি বর্গমিটার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬৬ হাজার ৯৬০ টাকা।
আবার ২নং ওয়ার্ডের দ্বিতীয়তলা অফিস ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি বর্গমিটারে ৫ হাজার ১৪ কোটি টাকা। ব্যয় প্রাক্কলনের তারতম্য এবং ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সম্পর্কে সভায় জানতে চাওয়া হয়। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফা কে. মুজেরী বলেন, দুর্নীতির সুযোগ রাখতেই উন্নয়ন প্রকল্পে এমন বাড়তি ব্যয় রাখা হয়।
এটা একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের অপসংস্কৃতি। মন্ত্রণালয় পর্যায়ে যেসব কমিটি আছে সেগুলো কাজ করলে এমন অতিরিক্ত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে আসার কথা নয়। সেই সঙ্গে জনবলের অভাবে অনেক সময় পরিকল্পনা কমিশনও সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে না। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে নানাভাবে অর্থের অপচয় হচ্ছে।
এটা বন্ধ করতে হবে। বিদেশ ভ্রমণ ও জ্ঞান অর্জনের নামে যে কী হচ্ছে সেটি মূল্যায়ন করা দরকার। প্রয়োজনে বিকল্প পথ বের করতে হবে। মন্ত্রণালয় পর্যায়ে প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে কঠোর হতে হবে।
সূত্র জানায়, পিইসি সভায় বলা হয়, বিভিন্ন ওয়ার্ডের অফিস ভবন নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয়ের তারতম্য রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২০ তলা ফাউন্ডেশনসহ ১০ তলাবিশিষ্ট ৩৭ হাজার ১৬১ দশমিক ২ বর্গমিটার পাবলিক হল ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয় ২৪৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিবর্গমিটার পাবলিক হল নির্মাণে খরচ হবে ৬৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। (প্রতি বর্গফুটের খরচ ৬ হাজার ১৬৭ টাকা)।
এর বাইরে পাবলিক হলের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বাবদ থোক চাওয়া হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এছাড়া এয়ারকন্ডিশন বাবদ সাড়ে ৫ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ড্রেনের জন্য দেড় কোটি টাকা, সোলার সিস্টেমের জন্য সাড়ে ৪ কোটি টাকা ধরা হয়। এসব ক্ষেত্রে পিইসি সভায় হল নির্মাণের যৌক্তিকতা, ব্যবস্থাপনা ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়।
আরও জানা যায়, প্রকল্পে রাস্তার বাতির জন্য পোলসহ সোলার ও নন-সোলার এলইডি লাইট স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে। এজন্য ২১টি আইটেমের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।
এ খাতের ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। প্রকল্পে ১১০টি কম্পিউটার ও ল্যাপটপ এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সংস্থান রাখা হয়েছে। এগুলো অত্যধিক বলে মনে করছে কমিশন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত