এক কর্মকর্তার স্ত্রী-ই অর্ধডজনের মালিক

| আপডেট :  ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০৯  | প্রকাশিত :  ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:০৯

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সেখানকার একজন কর্মকর্তার স্ত্রীর নামেই যদি ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের অর্ধডজন যাত্রীবাহী কিংবা মালবাহী জাহাজ থাকে, সেটিই যে কারও কপালে চোখ তুলবে!

শুধু স্ত্রীর নামে নয়, সদ্য স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের বেনামে আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ রয়েছে। সবমিলিয়ে ওই কর্মকর্তার দখলে রয়েছে এক ডজনের বেশি জাহাজের মালিকানা।

বিআইডব্লিউটিএ থেকে প্রাপ্ত রেজিস্ট্রেশন নথি অনুযায়ী, সাবেক উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ীর নামে ছয়টি জাহাজের মালিকানা রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এর সত্যতা মিলেছে। জাহাজগুলো হলো- এমভি আল জামিউ-৩, এমভি রাজহংস-৭, এমভি রাজহংস-৮, এমভি রাজহংস-১০, এমভি বন্ধন-৫ ও এমভি শাহরুখ-১। এর মধ্যে দুটি জাহাজ একক মালিকানায় আর চারটি যৌথ মালিকানায়। এগুলোর নথিপত্র এখন দুদকের হাতে রয়েছে।

এছাড়া আবু বকর সিদ্দিক ও ইসরাত জাহানের মালিকানায় আর কোনো জাহাজ বা অবৈধ সম্পদ আছে কি না— সে বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে। একই সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ’র আরও ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন দুদক উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আবু বকর সিদ্দিকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ইসরাত জাহানের যত সম্পদ

নৌ-যান নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে পাওয়া রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট অনুযায়ী ইসরাত জাহান পাপড়ীর নামে যেসব জাহাজ রয়েছে-

এমভি আল জামিউ-৩ : মেসার্স আল জামিউ শিপিং লাইন্সের অধীন এটি একটি মালবাহী জাহাজ। যেটির রেজিস্ট্রেশন হয় ২০১২ সালের অক্টোবরে। মালিক হলেন- মো. মোক্তার হোসেন ভূঁইয়া, আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ী, মো. আবদুর রশিদ ও মো. এখলাসুর রহমান রফিক।

এমভি রাজহংস-৭ : ৬৭৮ টনের এমভি রাজহংস-৭। ২০২০ সালের ১০ মে মেসার্স বে ওয়াটার সার্ভিস কোম্পানির (প্রতিষ্ঠান) আওতায় এটির রেজিস্ট্রেশন হয়। এর একক মালিকানায় রয়েছেন ইসরাত জাহান পাপড়ী।

এমভি রাজহংস-৮ : ১১৭৫ টনের এমভি রাজহংস-৮। মেসার্স বে-ওয়াটার ওয়েজ কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন হয়। যার মালিক হচ্ছেন- ইসরাত জাহান পাপড়ী ও অহিদুজ্জামান খোকা।

এমভি রাজহংস-১০ : ১৪৯৮ টনের এমভি রাজহংস ১০ বে-ওয়াটার সার্ভিস কোম্পানির নামে নিবন্ধিত। যার মালিকানাও ইসরাত জাহান পাপড়ীর একক নামে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল এর রেজিস্ট্রেশন হয়।

এমভি বন্ধন-৫ : ১২৬৯ টনের এমভি বন্ধন-৫ মেসার্স বন্ধন ওয়াটার ওয়েজ কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন হয় ২০১৬ সালের এপ্রিলে। যার মালিকানায় আছেন ইসরাত জাহান পাপড়ী ও মো. টিটু মিয়া। জাহাজটি ২০১৬ সালে নির্মিত হয়। মেসার্স সুন্দরবন শিপিং বিল্ডার্স এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

এমভি শাহরুখ-১ : ১৩৮৫ টনের এমভি শাহরুখ-১ মেসার্স শাহরুখ এন্টারপ্রাইজ কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি রেজিস্ট্রেশন হওয়া বহুতল জাহাজটির মালিকানায় আছেন পাঁচজন। তারা হলেন- মো. লুৎফর রহমান রুমি, মো. রফিক, মো. ওয়াহীদ, ইসরাত জাহান পাপড়ী ও নেয়ামত উল্লাহ।

অধিকাংশ জাহাজের মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র তিনি স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ীর নামে করেন। তার মালিকানাধীন জাহাজগুলোর মধ্যে রাজহংস-১০ এর যাত্রী ধারণক্ষমতা ৬১৬ জন। ১৫ কোটি টাকা মূল্যের জাহাজটি ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল রেজিস্ট্রেশন পায়।

দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিআইডব্লিউটিএ’র সাবেক উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক নামে-বেনামে ১৫টির বেশি জাহাজের মালিক। এসব অভিযোগের দায় নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর স্বেচ্ছায় অবসরে যান তিনি। অধিকাংশ জাহাজের মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র তিনি স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ীর নামে করেন। তার মালিকানাধীন জাহাজগুলোর মধ্যে রাজহংস-১০ এর যাত্রী ধারণক্ষমতা ৬১৬ জন। ১৫ কোটি টাকা মূল্যের জাহাজটি ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল রেজিস্ট্রেশন পায়।

এছাড়া এমভি রাজহংস-৭ ও ৮ এর প্রতিটির মূল্য ১২ থেকে ১৪ কোটি টাকা। রাজহংস-৮ এর মালিক হিসেবে ইসরাত জাহান পাপড়ী জাহাজ মালিক সমিতির সদস্য হন। সদস্য নম্বর-৭৩। মালিক সমিতির সবাই জানেন, স্ত্রী সামনে থাকলেও সবকিছু দেখভাল করেন আবু বকর সিদ্দিক।

অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ীকে জাহাজের মালিক দেখিয়ে দুটি কোম্পানি খোলেন আবু বকর সিদ্দিক। একটি হচ্ছে মেসার্স বে-ওয়াটার সার্ভিস লিমিটেড, অপরটি মেসার্স বন্ধন ওয়াটার ওয়েজ। যাত্রীবাহী জাহাজের পাশাপাশি বেনামে শিপিং লাইন্সের (কার্গো জাহাজ) ব্যবসাও আছে তার। আল জামিউ শিপিং লাইন্স লিমিটেডের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুটে পণ্য পরিবহন করে তার প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগ রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ’র সাবেক ও বর্তমান ১২ কর্মকর্তা যৌথভাবে ‘ডজন রোজ’ বা ‘১২ গোলাপ’ নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। এ কোম্পানির বহরে ইতোমধ্যে একাধিক জাহাজ চলাচল করছে। আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ নির্মাণাধীন। বিআইডব্লিউটিএ’র সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন হলেন এমদাদুল হক। তিনি নিম্নমান সহকারী পদ থেকে বরখাস্ত হন বলে দুদক সূত্রে জানা যায়।

এছাড়া রেজিস্ট্রেশনের সূত্র ধরে আরও কয়েকটি জাহাজের মালিকদের নাম জানতে পেরেছে দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত এ কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে ২৭৯.৭৫ টনের এমভি স্বর্ণদীপ-৪ নামের যাত্রীবাহী জাহাজ। মেসার্স তানজিল ট্রেডিং কোম্পানির নামে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই এর রেজিস্ট্রেশন হয়। যার মালিকানায় আছেন মো. আফছার উদ্দিন ও নিজাম উদ্দিন।

এমভি সোহেলী বরিশালের মেসার্স স্টার নেভিগেশন কোম্পানি কর্তৃক ২০১৬ সালে তৈরি এবং মেসার্স গোলাম রাব্বি নেভিগেশন কোম্পানির নামে ওই বছরের ১৬ জুন এর রেজিস্ট্রেশন হয়। ৬০০ টনের ডজন রোজ-১ ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে রেজিস্ট্রেশন পায়। যার মালিক হচ্ছেন রিয়াজুল ইসলাম।

এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ও জয়েন্ট স্টক কোম্পানি কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে নৌযানের মালিকানা ও রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রসহ বিভিন্ন নথিপত্র তলব করে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের বিভিন্ন সময়ে চিঠি দেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান। এরই মধ্যে বেশকিছু নথি দুদকের হাতে পৌঁছেছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। শিগগিরই আবু বকর সিদ্দিকসহ অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হতে পারে।

এসব বিষয়ে জানতে অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি দুদকের জনসংযোগ দফতরে খোঁজ নিতে বলেন। জনসংযোগ দফতরের উপপরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেকের কাছে জানতে চাইলে অনুসন্ধান পর্যায়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন তিনি।

সূত্র:ঢাকাপোস্ট

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত