এক নজরে নতুন সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার খসড়া
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা ৪৩ বছরের পুরোনো। এই প্রেক্ষাপটে নতুন আচরণ বিধিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ২০২২’ এর খসড়া করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে খসড়া বিধিমালায়। এছাড়া অনুমোদন ছাড়া কোনো কর্মচারী অনলাইন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সম্প্রচারেও অংশ নিতে পারবেন না। মূল্যবান সামগ্রী, অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা হস্তান্তর এবং উপহার গ্রহণের ক্ষেত্রেও নতুন নিয়মের কথা বলা হয়েছে খসড়া বিধিমালায়।
নতুন আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’এর আওতায় অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং এ বিধিমালার আওতায় অসদাচরণের দায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নতুন আচরণ বিধিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালাটি বেশ পুরোনো। এখন যুগ পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের কাজের পরিমাণ বেড়েছে। কর্মচারীদের মনোভাব এখন গণমুখী। সবকিছু মাথায় রেখে কর্মচারীদের আগের খোলস থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য নতুন আচরণ বিধিমালা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট সবগুলো আইন আধুনিক করার কাজ করছি। সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই নতুন আচরণ বিধিমালার খসড়া করা হয়েছে। আমরা দ্রুত এটি চূড়ান্ত করবো।’
সম্পদের হিসাব
খসড়া বিধিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী নির্ধারিত ছক অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তার বা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি এবং অলংকারাদিসহ নগদে রূপান্তরযোগ্য সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা করবেন।
প্রত্যেক কর্মচারী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ডিসেম্বর মাসে বিগত পাঁচ বছরের হিসাব বিবরণীতে প্রদর্শিত সম্পত্তির হিসাব বিবরণী বা আয়কর সনদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবে। সরকার আদেশের মাধ্যমে এই বিধির অধীনে সম্পত্তির হিসাব বিবরণী দাখিলের পদ্ধতি এবং যে কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবে তা নির্ধারণ করতে পারবে বলে বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আগের বিধিমালায় আয়কর বিবরণী দাখিলের বিষয়টি ছিল না, একই সঙ্গে অলঙ্কারের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে, সেটার হিসাব দিতে হতো। নতুন বিধিমালায় সেই সীমা তুলে দেওয়া হচ্ছে।
মূল্যবান সামগ্রী, অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা হস্তান্তর
কোনো সরকারি কর্মচারী ৫ লাখ টাকার বেশি মূল্যের কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচা বা অন্য কোনো পন্থায় হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধান বা সচিবকে জানাবেন। কর্মচারী নিজেই বিভাগীয় প্রধান হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে এবং সরকারের সচিব হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে সরকারের কাছে ঘোষণা দেবেন। এ ঘোষণায় সার্বিক অবস্থা, প্রস্তাবিত বা দাবি করা মূল্য এবং বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে হস্তান্তরের পদ্ধতির বিবরণ থাকবে।
সরকারি কর্মচারী বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সরকারের অনুমোদন ছাড়া কেনাবেচা, দান, উইল বা অন্যভাবে বহিঃবাংলাদেশ অবস্থিত কোনো স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। কোনো বিদেশি নাগরিক বিদেশি সরকার বা বিদেশি সংস্থার সঙ্গে কোনো প্রকার ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারবেন না কোনো সরকারি কর্মচারী।
কোনো সরকারি কর্মচারী নির্মাণ ব্যয় বা ক্রয়ের প্রয়োজনীয় অর্থের উৎস উল্লেখ করে এই উদ্দেশ্যে আবেদনের মাধ্যমে সরকারের অনুমোদন গ্রহণ ছাড়া ব্যবসায়িক বা আবাসিক ব্যবহারের অভিপ্রায়ে নিজে বা অন্য কোনো মাধ্যমে কোনো ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে বা কিনতে পারবেন না বলে খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
উপহার গ্রহণ নিয়ে যে নিয়ম আসছে
কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমতি ছাড়া নিকটাত্মীয় বা ব্যক্তিগত বন্ধু ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কোনো উপহার গ্রহণ বা তার পরিবারের কোনো সদস্যকে বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তিকে উপহার নেওয়ার অনুমতি দিতে পারবেন না, যে উপহার গ্রহণ সরকারি কর্তব্য পালনে তাকে কোনো ধরনের দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ করে।
তবে যদি মনোকষ্ট দেওয়া ছাড়া উপহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করা যায়, তাহলে উপহার গ্রহণ করে তা নিষ্পত্তির সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে যে ধর্মীয় বা সামাজিক প্রথা অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠান, বার্ষিকী, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপহার নেওয়ার নীতি প্রচলিত অনুষ্ঠানে দাপ্তরিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন নিকটাত্মীয় বা ব্যক্তিগত বন্ধুর কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করা যাবে। উপহারের মূল্য মূল বেতনের সমপরিমাণ বা ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তা সরকারকে অবহিত করতে হবে।
বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রতিনিধি কোনো উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দিলে, মনে কষ্ট দেওয়া ছাড়া উপহার গ্রহণ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর তা করা উচিত। যদি তা সম্ভব না হয় তবে তিনি উপহার গ্রহণ করতে পারবেন এবং নিষ্পত্তির আদেশের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উপহার গ্রহণের বিষয়টি জানাবেন।
সরকারের সচিব বা সমপদমর্যাদা সম্পন্ন কোনো কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠান প্রধান দেশে বা বিদেশে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি সরকারের কর্মকর্তার দেওয়া শুভেচ্ছা স্মারক উপহার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন। যদি গ্রহণ করা উপহার সরকারি অফিস বা সরকারি বাসভবনে ব্যবহার উপযোগী হয় তাহলে তা ব্যবহার করতে হবে। যদি ব্যবহার সম্ভব না হয় তবে সরকারি কর্মকর্তা তা নিজের ব্যবহারের জন্য রাখতে পারবেন।
সরকারি কর্মচারী তার কর্ম অধিক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ী বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সংস্থায় ব্যক্তিগত আতিথ্য পরিহার করবেন বলেও খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুমতি ছাড়া ফেসবুকের সম্প্রচারেও অংশগ্রহণ নয়
সরকারি কর্মচারী বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি বা প্রকৃত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র ছাড়া প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক বা অনলাইন মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) সম্প্রচারে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে নিজ নামে বা বেনামে বা অন্যজনের নামে কোনো নিবন্ধ বা পত্র লিখতে পারবেন না। অন্য বিষয়গুলো আগে থাকলেও ‘অনলাইন মিডিয়া’ ও ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’ নতুন বিধিমালায় যুক্ত করা হচ্ছে।
সরকারি কর্মচারী নিজ নামে প্রকাশিত কোনো লেখা বা জনসম্মুখে তার দেওয়া বক্তব্যে বা বেতার বা টেলিভিশন বা কোনো প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কোনো বিবৃতি বা মতামত প্রকাশ করতে পারবেন না, যা সরকারের সঙ্গে জনগণের কিংবা কোনো শ্রেণি বিশেষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকারকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলতে সক্ষম।
রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারবেন না
আগের মতোই সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হতে বা অন্য কোনোভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না বা বাংলাদেশ বিদেশের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারেই সহায়তা করতে পারবেন না।
সরকারি কর্মচারী নিজে বা তার পরিবারের কোনো সদস্যকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনে সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজ হিসেবে গণ্য এমন কোনো আন্দোলনে বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বা অন্য কোনো উপায়ে সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে নতুন বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্য অধিকার আইনের ক্ষেত্র ছাড়া তথ্য প্রকাশে মানা
খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী সরকারি দায়িত্ব পালনকালে তার দখলে থাকা দলিল, এসব দলিলের বিষয়বস্তু বা তথ্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বিভাগ বা সংযুক্ত দপ্তরে কর্মরত কোনো সরকারি কর্মচারীর কাছে বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির কাছে বা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারবেন না। তবে ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী যে সকল তথ্য প্রদানে বা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা এই বিধির আওতাভুক্ত হবে না।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে তদবির নয়
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী কোনো বিষয়ে তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক বা বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবেন না।
এতে আরও বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী তার চাকরি সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব খাটাতে পারবেন না। একইসঙ্গে চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যম ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো ধরনের আবেদন দাখিল করতে পারবেন না।
এতে আরও বলা হয়, কোনো সরকারি কর্মচারী নারী সহকর্মীর প্রতি কোনো প্রকারের এমন কোনো ভাষা ব্যবহার বা আচরণ করতে পারবেন না যা অনুচিত বা অসঙ্গত এবং দাপ্তরিক শিষ্টাচার ও নারী সহকর্মীদের মর্যাদাহানি ঘটায়। সরকারি কর্মচারীর অনুচিত বা অসঙ্গত ভাষা প্রয়োগ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সরকারের ব্যাখ্যা চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে।
কোনো সরকারি কর্মচারী বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। যদি কোনো সরকারি কর্মচারীর স্ত্রী বা স্বামী বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বিষয়টি সরকারকে লিখিতভাবে জানাবেন।
ফটকা কারবার, বিনিয়োগ, চাকরি-ব্যবসা
কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারবেন না যার মূল্য প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। তবে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোনো কোম্পানির প্রাথমিক শেয়ার বা বন্ড ক্রয়ে বিধি-নিষেধ কার্যকর হবে না।
নতুন বিধিমালায়ও কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে বা অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না।
তবে জাতীয় বেতন স্কেলের ১৭ থেকে ২০ গ্রেডভুক্ত সরকারি কর্মচারীরা অনুমোদন ছাড়া দাপ্তরিক দায়িত্বে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত রেখে পরিবারের সদস্যদের শ্রম কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে সম্পত্তির ঘোষণাপত্রের সঙ্গে ব্যবসার বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হবে বলে খসড়া বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত