এখন শেয়ার বিক্রি না করে যে কৌশলে চমক নিশ্চিৎ
ঈদ পরবর্তী পুঁজিবাজারে চলছে দরপতন। বাজারের এ অবস্থায়ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। আর তাতে সর্বশেষ চার কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন (পুঁজি) উধাও হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা।
এই অবস্থা থেকে উত্তোরণে আজ থেকে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সরকারি সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বাজারে ৫০-১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এছাড়া পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিল থেকে বাজারের উন্নয়নে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে। ফলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তাই এখন বিনিয়োগকারীদের প্যানিক হয়ে শেয়ার বিক্রি না করার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুর মধ্যে দেশের বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা ভয় ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এই ভয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তারা টাকা তুলে নিতে শেয়ার প্যানিক সেল দিচ্ছেন। প্যানিক সেলের পরিমাণ এতই বেশি যে বাজার আবারও দরপতনের ধারায় ফিরেছে। এর মধ্যে সোমবার ৯ মাসের মধ্যে বড় সূচক পতন হয়েছে।
এই দরপতনের নেপথ্যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের অর্থনীতি নিয়ে অনেকে কাল্পনিক মন্তব্য করছে বলে মনে করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিচিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিনিয়োগকারীরা অযথা প্যানিক হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন। তাতে ব্রোকার হাউজ কর্তৃপক্ষ ও ট্রেডাররা বিনিয়োগকারীদের মুখ দেখাতে পারছেন না, অনেকে ফোনও ধরছেন না।
নাম না প্রকাশ শর্তে লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজের একজন ট্রেডার বলেন, আমি ৫০০ ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করি, এর মধ্যে আমার পারসোনাল ক্লায়েন্ট রয়েছেন ১০০ জনের মতো। তারা বাজারের এই আচরণে প্রতিনিয়ত হতাশ হচ্ছেন, আমাকে ফোন দিয়ে বিভিন্ন কথা বলছেন, আমি যাদের টাকা বিনিয়োগ করতে বলেছিলাম, তাদের এখন মুখ দেখাতে পারছি না। পারতপক্ষে তাদের ফোন ধরছি না। আমরা নিজেরাও হতাশায় আছি। অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজছি।
বাজারে একটা ‘কিছু হচ্ছে’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী। তিনি বলেন, ডলারের অস্থিরতার প্রভাব সবজায়গাতে পড়েছে। পাশাপাশি জিনিসপত্র এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ঘটনা নিয়ে নানা রকম গুজবে বিনিয়োগকারীরা প্যানিক হয়ে শেয়ার বিক্রি করেছেন। এর আগে এরাই হুজুগে কিনেছিল। এদের বাধা দিয়ে লাভ নেই। তিনি বলেন, বাজারও অনেক পড়েছে, আশা করছি এখন বাড়বে।
তিনি বলেন, মার্কেটে শেয়ারের দাম কমার নিশ্চিয়ই কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে ডলারের দাম বেড়েছে, এ কারণে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছেন। আরেকটি হলো করোনার সময় ব্যবসা-দোকানপাট বন্ধ করে কিছু মানুষ শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিল। এখন তারা পুরোনো ব্যবসায় ফিরেছে। আবার কিছু লোক নতুন করে এসে বাজে শেয়ার কিনে ধরা খাচ্ছে, ব্যাংকের সুদ বেড়েছে। এগুলোর প্রভাব পড়েছে। তবে এই প্রভাব বেশিদিন থাকবে না। দ্রুত কেটে যাবে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, দরপতন ঠেকাতে পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। ফলে মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে ব্রোকার ডিলারের বিনিয়োগ ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ বেড়েছে। এছাড়াও আইসিবির বিনিয়োগ যাতে বাড়ে, তারা যেন বাজারকে সার্পোট দিতে পারে সেই চেষ্ঠা চালানো হচ্ছে। তারা আমাদের জানিয়েছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ৫০-১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
তিনি বলেন, আইসিবির যেসব টার্ম লোন রয়েছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আসবে। সেগুলো ডেফার (আমানতের মেয়াদ নবায়নের) করার জন্য সোনালী, জনতা, বিডিবিএল এই ধরনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকেও আমানত নবায়নের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করা হবে। এতে করে আইসিবির ফান্ড বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে। মার্কেট স্থিতিশীল ফান্ড থেকে আইসিবিকে অর্থ দেওয়া হবে। যাতে তারা পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়।
তবে টানা এই দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে দরপতনের যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো। সম্প্রতি সময়ে বেসরকারি খাতে আমদানি বেড়েছে। তাতে মনে হয়ে দেশে বিনিয়োগও হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে কিন্তু সেটা পুঁজিবাজারকে সরাসরি প্রভাব ফেলে না। কাজেই বিনিয়োগকারীরা কিছুটা অকারণে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন। এটার কোনো যুক্তিসঙ্গত ভিক্তি নেই।
ডলারের দাম বাড়া কিংবা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কোনো প্রভাব পড়ছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের তুলনা করাটা ঠিক না। কারণ আমাদের রিজার্ভ কিছু কমলেও এখনো ৫ মাসের আমদানি বিলের সমান রিজার্ভ রয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্বে কিছুটা মন্দা অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ার কথা না। এছাড়াও দেশের অর্থনীতি যে অবস্থা রয়েছে তাতে পুঁজিবাজারে বড় পতনের কোনো কারণ দেখি না। বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ দেখছি না। বিনিয়োগকারীদের উচিত প্যানিক সেল থেকে বিরত থাকা।
বাজারের উত্থান-পতন ঠেকানো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে কোনো ষড়যন্ত্র করে কোনো শেয়ার ওঠানামা করা হচ্ছে কি না সেটা দেখভালের দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
বাজার পরিস্থিতি
ঈদ পরবর্তী সপ্তাহে আট কর্মদিবস লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ কর্মদিবস দরপতন হয়েছে। সর্বশেষ চার কর্মদিবস টানা সূচক পতন হয়েছে। এই দরপতনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ২৬৭ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৪৩০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। তাতে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন উধাও হয়েছে ১৯ হাজার ২৭ কোটি ৭লাখ ৭৮ হাজার টাকায়।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত