এনবিআর’এ যেভাবে পদায়ন হচ্ছে গ্রেডেশন ছাড়াই
আয়কর আহরণে অবদান রাখছে কর পরিদর্শকরা। কিন্তু সেই কর পরিদর্শকদেরই আত্ম-মর্যাদা আর পদোন্নতির জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে ও সরাসরি (নন-ক্যাডার হতে),এই দুই পদ্ধতিতে নিয়োগ হয় কর পরিদর্শক। পদ্ধতি একই হলেও পদায়ন ও পদোন্নতি রয়েছে বিরাট ফারাক। আবার কর পরিদর্শক পদ ১০ম গ্রেডের।
অদ্ভুত হলেও সত্য যে, অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি) পদও ১০ম গ্রেডের। ফলে কর পরিদর্শক হতে সরাসরি ইএসিটিতে পদোন্নতি দিতে পারে না এনবিআর। সে জন্য কর পরিদর্শক হতে ইএসিটি পদে ‘পদায়ন’ করেই খালাস এনবিআর।
পদায়নের তালিকায় নাম তুলতে কর পরিদর্শকদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
আবার পদায়নের ক্ষেত্রে নিয়োগ বিধিমালা, জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি বিধিমালা-কিছুই মানা হয় না। মূলত এনবিআরে দুটি পদে ‘গ্রেডেশন তালিকা’ না করায় এই জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী কর পরিদর্শকরা। এই নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানছে না এনবিআর। তাদের অভিযোগ, গ্রেডেশন ছাড়াই ২০১৯ সালে ১৩০ কর পরিদর্শককে ইএসিটি হিসেবে পদায়ন করা হয়, যাতে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় না নিয়ে কেবল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পদায়ন করা হয়। চলতি মাসে আবারও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৪৪ জনকে পদায়নের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। গ্রেডেশন তালিকা করার আগ পর্যন্ত টাকার বিনিময়ে আইনবহির্ভূত এই পদায়ন স্থগিত করতে সম্প্রতি এনবিআর ও দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
কর পরিদর্শকদের পক্ষ থেকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘কর পরিদর্শক ও ইএসিটি পদ-উভয় ১০ম গ্রেড। এনবিআরের নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৬ অনুযায়ী কর পরিদর্শকদের মধ্য হতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ইএসিটি পদে বদলির মাধ্যমে পদায়ন করা হয়। নন ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা, ২০১১-এর বিধি-৪ অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। জ্যেষ্ঠতা বিষয়ে হাইকোর্ট ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন মামলা চলছে। এনবিআর, উচ্চ আদালত ও আইনের তোয়াক্কা না করে বরাবরই বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করে প্রতিবার ওই একই কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে কর পরিদর্শকদের মধ্য হতে ইএসিটি পদে পদায়ন করে যাচ্ছে। কর পরিদর্শক পদের কোনো গ্রেডেশন তালিকা ছাড়াই ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ১৩০ জনকে ইএসিটি পদে বদলির মাধ্যমে পদায়ন করা হয়েছে।’
অভিযোগ করে বলা হয়, ‘নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা, ২০১১-এর বিধি-৯ অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রকাশের বিধান রয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেডেশন তালিকা করা হয়নি। আবার একইভাবে আগামী ২৮ ডিসেম্বর কোনো গ্রেডেশন ছাড়াই ৪৪ জন কর পরিদর্শককে ইএসিটি পদে বদলির মাধ্যমে পদায়ন করা হচ্ছে। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রের আইনের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ব্যক্তি স্বার্থ এমনি কাজ করে না। কর্মকর্তাদের পারিবারিক ভোগ বিলাস ও উচ্চবিত্তদের স্বপ্ন পূরণের জন্য অজ্ঞাত উৎস হতে টাকা সরবরাহ করা হচ্ছে। একজন দিচ্ছে, আরেকজন পাচ্ছে।
শোনা যাচ্ছে প্রতি প্রার্থী হতে ৫ লাখ টাকা করে, ৪৪ জন হতে ২ কোটি ২০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এতে রাষ্ট্রে দুর্নীতি বাড়বে বৈ কমবে না। স্বার্থ যাই হোক, আইনবহির্ভূত কাজ তো চলতে পারে না।’ এনবিআর ও দুদক যদি চলমান আইনবহির্ভূত কাজকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসে, তবে রাষ্ট্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। ২৮ ডিসেম্বর আইনবহির্ভূত পদায়ন স্থগিত করে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে এসে সংকট নিরসনে দুদক ও এনবিআরের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
অন্যদিকে একাধিক কর পরিদর্শক জানিয়েছেন, জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫ অনুযায়ী কর পরিদর্শক পদ ১০ম গ্রেডের। নিয়োগ বিধিমালা ও পিএসসি’র সুপারিশে কোটা অনুযায়ী, প্রধান সহকারী, উচ্চমান সহকারী, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর, ব্যক্তিগত সহকারী এবং সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর হতে বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে ‘কর পরিদর্শক’ হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। আবার এনবিআরের চাহিদা অনুযায়ী পিএসসি সরাসরি কর পরিদর্শক ও ইএসিটি (নন-ক্যাডার) হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করে। বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৮০ শতাংশ আর সরাসরি ২০ শতাংশ নিয়োগের মাধ্যমে এনবিআর কর পরিদর্শকের চাহিদা পূরণ করা হয়। বর্তমানে কর পরিদর্শকের পদ সংখ্যা ৯৬৬ ও ইএসিটি পদ সংখ্যা ১৯৩টি।
অভিযোগ করে তারা বলেন, কর পরিদর্শক হতে ইএসিটি পদে পদায়নে এনবিআর কখনও কোনো গ্রেডেশন তালিকা করেনি। আইনবহির্ভূতভাবে কর পরিদর্শক হিসেবে পদায়নে সেই কোটা পদ্ধতি অনুসারে ইএসিটিতে পদায়ন করে আসছে এনবিআর। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ইএসিটি পদায়নে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা অনুসরণ করার কথা। আবার কোটা অনুসরণ করে পদায়ন করা হলেও কথা ছিল। কিন্তু গ্রেডেশন না করায় ইএসিটি হিসেবে পদায়নে তালিকায় নাম লেখাতে শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। জ্যেষ্ঠতা নয়, যে যত বেশি টাকা দিতে পারে, সে তালিকায় স্থান পায়। ফলে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে অনেকেই ইএসিটি হওয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ পদায়নে পর্যন্ত স্থান পায় না।
ভুক্ত কর পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, গ্রেডেশন তালিকা নিয়ে বিপত্তি শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে। ৩৪তম বিসিএস নন-ক্যাডারে ১০ম গ্রেডে ৩১৮ জনকে কর পরিদর্শক ও ৬ জনকে ইএসিটি হিসেবে সুপারিশ করা হয়। একই বছর এনবিআর বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৪৫০ জনকে কর পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি দেয়। নন-ক্যাডার হতে সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৫০ জন একই বছরের ১২ মার্চ যোগদান করে।
এনবিআর পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও নন-ক্যাডার থেকে আগত কারোই গ্রেডেশন তালিকা করেনি। গ্রেডেশন তালিকা ছাড়াই পদ খালি হওয়া সাপেক্ষে কর পরিদর্শক থেকে ইএসিটি হিসেবে পদায়ন করে আসছে এনবিআর; যাতে জ্যেষ্ঠতার নয় টাকার বিনিময়ে পদায়ন করা হয় বলে অভিযোগ করেন তারা। তাদের অভিযোগ, পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৪৫০ জনের মধ্য থেকে ২০১৯ সালে ১৩০ জনকে ইএসিটি হিসেবে পদায়ন করা হয়। সেখানেও জ্যেষ্ঠতার নিয়ম না মেনেই প্রার্থীপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। এসব ইএসিটি পদায়নে জ্যেষ্ঠতা নয় বরং সেই কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করে এনবিআর। মূলত গ্রেডেশন তালিকা না থাকায় এনবিআর আইনবহির্ভূতভাবে কোটা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, শুধু গ্রেডেশন নয়, আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে চরম বৈষম্য। পদায়ন করা ইএসিটি চাকরি ৩ অতিক্রম করলে কোনো প্রকার বিভাগীয় পরীক্ষা ছাড়াই সহকারী কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। অথচ নন-ক্যাডার থেকে আসা কর পরিদর্শকদের ইএসিটি হিসেবে পদায়নে ‘বিভাগীয় পরীক্ষায়’ উত্তীর্ণ হওয়ার শর্ত দেয়া হয়। নন-ক্যাডাররা যোগ্যতায় এগিয়ে থাকলেও শর্তের বেড়াজালে আটকে দেয়া হচ্ছে পদোন্নতি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আরও একটি শর্তে বলা হয়েছে, ‘একই পঞ্জিকাবর্ষে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মচারী সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠ হবেন।’ এর অর্থ হলো, কর পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৪৫০ জন কর পরিদর্শক নন-ক্যাডার থেকে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ৩১৮ জন কর পরিদর্শকের জ্যেষ্ঠ হলেন। অর্থাৎ এই ৪৫০ জন ইএসিটি হিসেবে পদায়নের পর ৩১৮ জনের সিরিয়াল আসবে।
অনেকেই ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ইএসিটি পদায়নে পিএসসি’র সুপারিশের প্রয়োজন হয় না। তবে ইএসিটি হতে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতির জন্য পিএসসি’র সুপারিশ প্রয়োজন হয়। বৈষম্য দূর করতে নন-ক্যাডার থেকে আগত কর পরিদর্শকরা পিএসসি’র সহযোগিতা চেয়ে কয়েকবার চিঠি দিয়েছে। তবে কোনো সমাধান পায়নি। আবার পিএসসি একই অর্ডারে ৩১৮ জনকে কর পরিদর্শক ও ৬ জনকে ইএসিটি হিসেবে সুপারিশ করে। একই গ্রেডে দুই পদে সুপারিশ করা হয়। পিএসসি আর এনবিআরের খামখেয়ালির কারণে একই অর্ডারে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬ জন ইএসিটিদের অধীনে কর পরিদর্শকদের চাকরি করতে হচ্ছে।
ক্ষোভ জানিয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একই অর্ডারে নিয়োগপ্রাপ্ত ইএসিটিরা তিন বছর পর কোনো বিভাগীয় পরীক্ষা ছাড়াই সহকারী কর কমিশনার হয়ে যাবেন। কিন্তু নন-ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর পরিদর্শকরা জানেন না, কবে তারা ইএসিটি হবেন। গ্রেডেশন তালিকা প্রণয়ন, সরাসরি ইএসিটি নিয়োগ বন্ধ, কর পরিদর্শকদের বিভাগীয় পরীক্ষা বাতিল ও ৬ জন ইএসিটির জ্যেষ্ঠতা বাতিলের জন্য ভুক্তভোগী কর পরিদর্শকরা উচ্চ আদালতে রিট করেছে। কিন্তু এনবিআর এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কর পরিদর্শকরা।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রেডেশনসহ কর পরিদর্শকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে এনবিআর কাজ করছে। তবে লেনদেন হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
সূত্র: শেয়ার বিজ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত