এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়কে স্বপ্নের চার লেন যেন থমকে আছে
১৯০ কিলোমিটারের এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। কথা ছিল, ২০২১ সালের আগস্টে টানা হবে কাজের যবনিকা। মেয়াদ পার হলেও এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ৪৩ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে বেড়েছে প্রকল্পের মেয়াদ, বাড়ানো হয়েছে খরচও। মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এখন ৪ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা বেড়ে তা ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কাজ শেষ করার নতুন সময় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর।
তবে প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এর প্রধান কারণ হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দায়ী করছেন সংশ্নিষ্টরা। প্রতিষ্ঠানটি থেকে সময়মতো অর্থছাড় না হওয়া এবং প্রয়োজনীয় মালপত্র সংকটের কারণে মহাসড়কের তিনটি বড় স্পটে এক বছর ধরে কাজ বন্ধ। বাকি ছয় স্পটের কাজেও শামুকগতি। সামনে অতিবৃষ্টির মধ্যে কাজ আরও শ্নথ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, প্যাকেজ-৫-এর আওতায় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পর্যন্ত ১৩.৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের চুক্তি ৯ মাস আগে হলেও এখনও কাজে হাতই দেওয়া হয়নি। একইভাবে প্যাকেজ-১৩-এর আওতায় হাটিকুমরুল মোড়ের ইন্টারসেকশনের কাজ এখনও শুরু করা যায়নি।
স্বপ্নের চার লেন: এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) এবং বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের আটটি মহাসড়ক যুক্ত হবে। ওই সড়কগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬০০ কিলোমিটার। এরই মধ্যে সাসেক-১-এর আওতায় গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে চন্দ্রা হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন সড়কের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সাসেক-২-এর আওতায় চলছে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর পর্যন্ত মহাসড়কের কাজ। এ ছাড়া সাসেক-৩-এর আওতায় রংপুর-লালমনিরহাট-বুড়িমারী পর্যন্ত চার লেন প্রকল্প এবং সাসেক-৪-এর আওতায় রংপুর-সৈয়দপুর-ঠাকুরগাঁও-বাংলাবান্ধা চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের সমীক্ষা চলছে।
এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর চার লেন প্রকল্পের খরচের মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) দিচ্ছে ১১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আর সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। রংপুর-সৈয়দপুর-বাংলাবান্ধা চার লেন হয়ে গেলে ওই মহাসড়কের মাধ্যমে ভারতে ঢোকা যাবে। ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারে ওই করিডোরটি রাখবে অবদান। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সহজ করতেও সড়কটি রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
প্রকল্পের আওতায় মহাসড়কের উভয় পাশে অপেক্ষাকৃত ধীরগতির যানের জন্য স্লো মুভিং ভেহিক্যাল ট্রাফিক (এসএমভিটি) লেন নির্মাণ করা হবে। ১৯০ কিলোমিটার পথের যেখানে যানজট বেশি এমন ছয় স্থানে হবে ফ্লাইওভার। এ ছাড়া ৫০ কিলোমিটার কংক্রিট পেভমেন্ট, ২৬টি সেতু, ৩৯টি আন্ডারপাস, ১৮০টি কালভার্ট এবং হেঁটে পারাপারের জন্য থাকছে ১১টি পথচারী সেতু।
কাঠগড়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মোনেম’: সড়ক ও জনপথ বিভাগের সূত্র বলছে, মোনেম গ্রুপের কর্ণধার আবদুল মোনেম ২০২০ সালের ৩ মে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ঠিক গতিতে চলছিল। পরে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন মোনেমের দুই ছেলে এ এস এম মাঈনুদ্দিন মোনেম ও এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম। অভিযোগ আছে, তাঁরা চলমান কাজের যথাযথ দেখভাল করছেন না। এসব কারণে দুই মাস আগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডকে নোটিশ টু কারেক্ট (সতর্কবার্তা) দেওয়া হয়েছে। এই চিঠির জবাবে তারা সওজ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, সঠিক সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।
সড়ক বিভাগের সূত্র বলছে, ১৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে আবদুল মোনেম লিমিটেড, মনিকো লিমিটেড, কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড ও চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কাজ করছে। এর মধ্যে মোনেম লিমিটেড ছাড়া অন্যদের কাজের গতি ভালো। তবে জটিলতা দেখা দিয়েছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসন এখনও জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় ঠিকাদার কাজও শুরু করতে পারেননি।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, ‘কিছু সমস্যা ছিল। এগুলো স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হয়েছে। এখন শিগগিরই সড়ক বিভাগের কাছে অধিগ্রহণ না হওয়া জমিগুলো দিতে পারব।’
কাজের ধীরগতি প্রসঙ্গে আবদুল মোনেম লিমিটেডের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চুক্তির সময়ের মধ্যেই আমরা সব কাজ শেষ করে ফেলব। এর আগে করোনার কারণে চলমান কাজে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এর পরও আমরা চেষ্টা করছি ঠিকমতো কাজ চালাতে। তিনি দাবি করেন, মহাসড়কের তিনটি বড় স্পটে কাজ বন্ধ করা হয়নি, গতি কম হয়েছে।
প্রকল্পের কাজে শামুকগতি: এলেঙ্গা থেকে রংপুরের মডার্ন মোড় পর্যন্ত প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্যাকেজ-৫-এর আওতায় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পর্যন্ত এলাকা। ১৩.৬ কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণে আবদুল মোনেম লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় গত ২২ আগস্ট। ৬০১ কোটি ১১ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যে কাজের মেয়াদ ধরা হয় তিন বছর। তবে এখনও কাজে হাতই দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। সে হিসাবে এখানে কাজের অগ্রগতি শূন্য। সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, দ্রুতগতিতে কাজ করলেও এটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করা অসম্ভব ব্যাপার।
এই সড়ক ছাড়াও হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার বনানী পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ করছে আবদুল মোনেম লিমিটেড। দেখা গেছে, শেরপুর উপজেলার দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা ঘোগাব্রিজ, ছোনকা বাজার ও মির্জাপুর বাজার এলাকায় ওভারপাস ও আন্ডারপাসের কাজ এক বছর ধরে বন্ধ। কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে থাকায় ওই এলাকার মানুষের চলাচলে ভোগান্তি বেড়েছে বহু গুণ। একইভাবে সড়কের মির্জাপুর বাজার থেকে ছোনকা বাজার, ছোনকা থেকে চান্দাইকোনা বাজার, সিরাজগঞ্জের ঘুড়কা বেলতলা বাজার, সাহেবগঞ্জ বাজার, সলঙ্গা বাজার ও কামারবাড়ী সেতু এলাকার কাজ চলছে একেবারেই ধীরগতিতে। এ ছাড়া শেরপুর থেকে বগুড়া শহরের বনানী পর্যন্ত চলমান কাজও শ্নথ।
রাস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটি থাকার কারণেও কাজ চলছে ধীরগতিতে। আর এই খুঁটি সরাতে কয়েক বছর ধরে চালাচালি হয়েছে অসংখ্য চিঠি। তবুও হয়নি সমাধান। এ কারণে খুঁটিতেই আটকে আছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ। খুঁটি সরানোর বিষয়ে নেসকো রাজশাহীর প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক (কারিগরি ও অপারেশন) প্রকৌশলী আবদুল আজিজ বলেন, খুঁটিগুলো তুলে নতুন কোথায় বসাব, তারও কোনো নির্দেশনা সড়ক কর্তৃপক্ষ দেয়নি। তার পরও আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি।
হাটিকুমরুল ইন্টারসেকশনের কাজ শুরুই হয়নি: গাড়ি কোনো বাধা না পেয়ে সোজা চলে যেতে পারবে মহাসড়ক ধরে। ফরিদপুরের ভাঙ্গার মতো হাটিকুমরুল মোড়েও হবে একটি ইন্টারসেকশন। এই ইন্টারসেকশনের কাজ এখনও শুরুই করা যায়নি। প্যাকেজ-১৩-এর আওতায় এটি নির্মাণে খরচ হবে ৭৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট ইন্টারসেকশনের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
হাটিকুমরুল ইন্টারসেকশন প্রকল্পের কর্মকর্তা জয় প্রকাশ চৌধুরী বলেন, হাটিকুমরুল গোলচত্বরে ইন্টারসেকশনের সঙ্গে চার লেনের যে সংযোগ হবে, তাতে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-পাবনার জন্য আলাদা লেন থাকবে। এতে দূরপাল্লার যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির গাড়ির জন্যও থাকছে আলাদা লিঙ্ক রোড। এখন প্রকল্প এলাকায় বেজ ক্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে।
ঝামা ইটের খোয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন: মহাসড়কে নির্মাণে ঝামা ইটের খোয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডি বলেছে, সড়ক নির্মাণে কোনো কোনো স্থানে ঝামা ইটের (পুড়ে কালো হওয়া) খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এই মহাসড়ক টেকসই হবে না। আইএমইডি ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ওই প্রতিবেদন দিয়েছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) লক্ষ্য অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় সরকারের অনেক সময় ও অর্থের অপচয় হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে ঠিকাদারকে জনবল ও নির্মাণসামগ্রীর মোবিলাইজেশন বাড়াতে হবে।
কারা কী বলছেন: আইএমইডির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘আমরা আইএমইডিকে প্রতিবেদনের জবাব দিয়েছি। আইএমইডি কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কিছু পোড়া ইট দেখেছেন। তবে ওই ইট আমরা সড়কে ব্যবহার করিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ধীরগতি কাজের জন্য আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুই মাস আগে চিঠি দিয়েছি। এর পরও তাদের কাজের গতি আশাব্যঞ্জক নয়। করোনা ও বৃষ্টির কারণে প্রকল্পের কাজের গতি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সময় বাড়ানো হয়েছে।’
অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হামিদুল হক বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগে এই মেগা প্রকল্পের কাজের বেশির ভাগ অংশ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। আবদুল মোনেম লিমিটেডের কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত। তাদের তাগাদা দিয়েও লাভ হচ্ছে না।’
সূত্র: সমকাল
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত