এয়ারলাইনসগুলোর টিকিটের মূল্য সহসাই কমছে না যেসব কারণে

| আপডেট :  ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:৫১  | প্রকাশিত :  ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:৫১

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে পুরোদমে চলছে কর্মী রফতানি। আবার ব্যবসা ও ভ্রমণের জন্য আগে যারা সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় যেতেন করোনার কারণে প্রবেশ ও চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ হওয়ায় বিকল্প হিসেবে তারা যাচ্ছেন দুবাইয়ে। শুধু তাই নয়, ঢাকা থেকে অস্ট্রেলিয়া কিংবা জাপানে যেতে হলেও যাত্রীদের মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনসগুলোই মূল ভরসা। এ অবস্থায় আসন সংখ্যার কয়েক গুণ যাত্রী বেড়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে আকাশপথে অস্বাভাবিক হারে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী দেশী-বিদেশী সব এয়ারলাইনস।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী কর্মী ও ভ্রমণ ভিসায় প্রায় ৫ হাজার যাত্রীর চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরব ওমরা হজেরও অনুমতি দিয়েছে। করোনার পর এখন ঢাকার দূতাবাস থেকে ভিসা প্রদানের হার বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে চার হাজার ভিসা দিচ্ছে সৌদি দূতাবাস। একদিনে ৮ হাজার ৬০০ ভিসাও দেয়া হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে প্রবাসী নতুন কর্মী হিসেবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে কেবল সৌদি আরবেই গিয়েছেন ৭১ হাজার ৭২৫ জন বাংলাদেশী। সব মিলিয়ে ঢাকা থেকে সৌদিগামী যাত্রী বেড়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত বর্তমানে বিশ্বের পর্যটন ও ব্যবসার হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দুবাইয়ে গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘দুবাই এক্সপো’। বিশ্বের ১৯২টি দেশের অংশগ্রহণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হওয়া এক্সপোতে রয়েছে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন। যা আগামী বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলবে। করোনার কারণে সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ের মতো গন্তব্যগুলোতে প্রবেশ কঠিন হওয়ায় বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা বর্তমানে যাচ্ছেন দুবাই। আবার পর্যটনের জন্যও যারা এর আগে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে ভ্রমণ করতেন, তারাও এখন দুবাই যাচ্ছেন। কারণ করোনা পরিস্থিতিতেও দুবাইয়ের ভ্রমণ ভিসা বাংলাদেশীদের জন্য এখন অনেক সহজ। এর সঙ্গে রয়েছে প্রবাসী কর্মীর যাতায়াত। বাংলাদেশ থেকে যারা ইউরোপ-আমেরিকা যাচ্ছেন তারাও অধিকাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক এয়ারলাইনসগুলোর মাধ্যমে যাচ্ছেন।

আবার মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ট্রানজিট নিয়ে অন্য দেশে যাওয়ার পথও বাংলাদেশীদের জন্য বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ট্রানজিট যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডগামী যাত্রীদেরও দুবাই কিংবা মাসকাটে ট্রানজিট নিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসী কর্মীর চাপ। ফলে বহির্বিশ্বগামী সব যাত্রীর চাপ গিয়ে পড়ছে মূলত বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কয়েকটি এয়ারলাইনসের ওপর। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এমিরেটস এয়ারলাইনস কিংবা কাতার এয়ারওয়েজের মতো মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এয়ারলাইনসগুলো ভারত, নেপাল কিংবা শ্রীলংকার তুলনায় বাংলাদেশ থেকে যাত্রী পরিবহনের সময় দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া নিচ্ছে।

ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে মূলত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইনসগুলোর ভাড়াই সব থেকে বেশি বেড়েছে। গত নভেম্বরেও ঢাকা থেকে সৌদিগামী ফ্লাইটগুলোর একমুখী টিকিট ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় পাওয়া গেলেও চলতি মাসে ৭০ হাজার টাকার নিচে পাওয়াই দুষ্কর। অন্যদিকে ঢাকা-দুবাই রুটের একমুখী ভাড়া বর্তমানে ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। আর ঢাকা-মাসকাটের একমুখী ভাড়াও ৭০ হাজার টাকার বেশি। যদিও এসব রুটের ভাড়া গত মাসেও ছিল ৪০ হাজারের মধ্যে।

এয়ারলাইনসগুলোর অস্বাভাবিক ভাড়া প্রসঙ্গে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) শেয়ারট্রিপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সোহেল মাজিদ বলেন, করোনাকালীন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট চালু হলেও অনেক ক্ষেত্রেই করোনা পূর্বাবস্থার মতো ফ্লাইট নেই। আবার কিছু দেশ ফ্লাইট চালুর অনুমতি দিলেও ট্রানজিট যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়নি। ফলে কয়েকটি এয়ারলাইনসই বাংলাদেশের বহির্বিশ্বগামী সিংহভাগ যাত্রী পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছে। ফলে চাহিদা বাড়ায় এয়ারলাইনসগুলো ভাড়া বাড়িয়েছে। আবার যাত্রী চাহিদা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইটও বাড়াতে পারছে না। কারণ বর্তমানে সেই পরিমাণ সক্ষমতা নেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকেও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনার এ পরিস্থিতিতে যতদিন দেশের অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে না, ততদিন অতিরিক্ত ভাড়ার এ সমস্যার সমাধান করা কঠিন। অন্যদিকে জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি এবং বিমানবন্দরের বিভিন্ন ফি বেড়ে যাওয়াকেও টিকিটের দাম ঊর্ধ্বমুখীর জন্য দায়ী বলছে এয়ারলাইনসগুলো।

আন্তর্জাতিক বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী, এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রি হয় কয়েকটি স্ল্যাব বা ধাপে। একই ফ্লাইটে একেক স্লাবের টিকিটের মূল্য একেক রকম। এ কারণে যত আগে কেনা যাবে, ততই কম হবে টিকিটের দাম। আর সময় বাড়তে থাকলে টিকিটের দামও বেশি হবে।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলোর সব টিকিটই উচ্চ স্লাবে বিক্রি করছে এয়ারলাইনসগুলো। এ কারণে আগে কিনলেও টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিক বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে যাত্রীদের। ভুক্তভোগী বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীদের অভিযোগ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এয়ারলাইনসগুলো ভাড়া বাড়িয়েছে। এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতি হয়নি। গত অক্টোবরেও ভাড়া অনেক সহনশীল ছিল। মূলত নভেম্বর থেকে অস্বাভাবিক ভাড়া আদায় করছে এয়ারলাইনসগুলো।

এদিকে এয়ারলাইনসগুলোর ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে জানতে সম্প্রতি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসসহ সবক’টি এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনলাইনে বিশেষ বৈঠক করেন।

এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি দুঃখজনক। যদিও কমার্শিয়াল ইস্যুতে বেবিচকের হস্তক্ষেপ করার তেমন সুযোগ নেই। তার পরও আমরা এয়ারলাইনসগুলোকে ডেকে ভাড়া কমানোর নির্দেশ দিয়েছি। কারণ ভারত, নেপাল, পাকিস্তান আশপাশের কোনো দেশের ভাড়া বাড়েনি। শুধু ঢাকায় কেন এত ভাড়া বাড়বে। তিনি জানান, এ বিষয়ে এয়ারলাইনসগুলোর পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া না গেলেও উল্টো তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের চার্জ বাড়ানোর বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছে।

এদিকে টিকিটের দাম বাড়ানো ও আসন সংকট নিরসনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সি অব বাংলাদেশ (আটাব)। চিঠিতে আটাব বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণকারীদের অধিকাংশ যাত্রী প্রবাসী কর্মী, যারা দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। অতিসম্প্রতি দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ কারণে প্রবাসী যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এভাবে ভাড়া বাড়ানো অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত মনে করে আটাব।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের নভেম্বরে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৩ জন কর্মী জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গেছেন। যা করোনা মহামারীর মধ্যে নতুন রেকর্ড। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর (জানুয়ারি-নভেম্বর) ১১ মাসে যে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন তাদের মধ্যে এককভাবে সৌদি আরবেই গেছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার ১৪ জন। অর্থাৎ ৭৬ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। এছাড়া ওমানে ৪০ হাজার ৮৬ জন, সিঙ্গাপুরে ২১ হাজার ৩৩৯, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ হাজার ২৭৪, জর্ডানে ১১ হাজার ৮৪৫ ও কাতারে ৯ হাজার ৭২৮ জন কর্মী গেছেন।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, ফ্লাইটের ভাড়ার প্রতি আমরাও সংবেদনশীল। আমরাও চাই যেসব কর্মী প্রবাসে যায়, তারা যেন কম ভাড়ায় যেতে পারে। আমরা এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়েও মিটিং করেছি। ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সিভিল এভিয়েশনকেও অনুরোধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সূত্র: বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত