কেউ পদোন্নতি পায় না, আবার কেউ পেয়ে কাজই করেন না
অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি হয়েছে গত বুধবার। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, টেলিফোনে বা সরাসরি চলছে অভিনন্দন জানানোর প্রতিযোগিতা। জুনিয়র কর্মকর্তারা পদোন্নতিপ্রাপ্তদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন, অধস্তনরা জানাচ্ছেন, সিনিয়ররাও জুনিয়রদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রভাব-বলয়ে ঢুকে পড়া পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ সূত্রটা ঝালাই করে নিচ্ছেন অবসরপ্রাপ্তরাও।
ঠিক ছয় মাস আগে একই পদে পদোন্নতি হয়। এক পদোন্নতি থেকে অন্য পদোন্নতির মধ্যে সময় পার হয়েছে মাত্র ছয় মাস। এ সময়ের মধ্যে প্রথম দফায় পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। ইনসিটু এবং সংযুক্তির নামে আগের দায়িত্ব পালন করছেন ৭৯ ভাগ কর্মকর্তা। নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন ১৪ শতাংশ কর্মকর্তা। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া যায়।
এই ভারসাম্যহীন অবস্থার কারণ জানতে চাইলে জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ কর্মকর্তা আগের দায়িত্বই পালন করেন। এটা এক দিনে হয়নি। পদের চেয়ে বেশি কর্মকর্তা পদোন্নতি দিতে গিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন হওয়ার কথা পিরামিড আকৃতির। অর্থাৎ নিচের দিকে বেশি কর্মকর্তা, ওপরের দিকে অল্প। অনেক আগেই সেটা পেটমোটা প্রশাসন হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি পদেই অতিরিক্ত কর্মকর্তা। ইনসিটু বা সংযুক্তি দিয়ে প্রশাসন চলছে।
জানা গেছে, প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের পদ ২১২টি। বর্তমানে এ পদে কর্মরত আছেন ৪৯৯ জন। ৫০২টি যুগ্ম সচিবের পদে কর্মরত ৬৫৮ জন। উপসচিব পদ এবং কর্মরত কর্মকর্তার সংখ্যা কাছাকাছি হলেও ২৮তম ব্যাচের পদোন্নতি নিয়ে কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ পদোন্নতির পর পদের তুলনায় কর্মকর্তার সংখ্যাও অনেক বেশি হবে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘পদোন্নতির পরপরই যারা অবসরে যান সেখানেও একটা বঞ্চনা আছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যথাসময়ে পদোন্নতি পাননি। সেজন্য অবসরের আগে পদোন্নতি দিয়ে সম্মানিত করা হয়।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে আগের দায়িত্বে ইনসিটু বা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি দেওয়া হয়। ইনসিটু হলে আগের পদেই বসতে হয়। আর সংযুক্তির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বা বিভাগ একই থাকে, শুধু কর্মকর্তার পদবি বদল হয়। সংযুক্তির ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ কর্মকর্তাই আগের কাজ করেন।
গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর ৮৭ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর ঠিক ১৬ দিন পরে অবসরে যান এএসএম মঞ্জুরুল কাদের। পদোন্নতির আগে তিনি হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক ছিলেন। পদোন্নতির পরে অবসরে যাওয়ার আগেও তিনি এ পদেই ছিলেন।
পদোন্নতির দুই মাসেরও কম সময়ে অবসরে যান সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো. রেজাউল হায়দার। গত ৩ নভেম্বর তিনি অবসরে যান। গত ১৯ ডিসেম্বর অবসরে যান মো. শওকত আলী। তিনি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন। গত ২৮ ডিসেম্বর অবসরে যান রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. জাকির হোসেন। এ বছরের ১৮ জানুয়ারি অবসরে যান সৈয়দ এমদাদুল হক। পদোন্নতির আগে ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। পদোন্নতির পর একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হন তিনি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান আ ন ম আজিজুল হক। পদোন্নতির আগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং পরে একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, পদোন্নতির পরপরই যাদের অবসরে যাওয়ার কথা তাদের পদোন্নতি দেওয়া উচিত না। কারণ যে কর্মকর্তা পদোন্নতির পর প্রজাতন্ত্রকে সেবা দেবেন না তার পদোন্নতি না পাওয়াই উচিত। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পারিশ্রমিক পান। শ্রম দেওয়ার বিপরীতে তাদের এ পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। পদোন্নতির পরপরই অবসরে চলে গেলে ‘পাবলিক মানির’ উপযুক্ত ব্যবহার হয় না।
ছয় মাস আগের পদোন্নতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, পদোন্নতির পরদিন অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ২৫ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির ঠিক পূর্বমুহূর্তের কর্মস্থলেই (ইনসিটু) বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ পদোন্নতির আগে এসব কর্মকর্তা যে দপ্তরের যে পদে দায়িত্ব পালন করেছেন পদোন্নতির পরও তারা একই পদে পদায়িত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া মো. মিজানুর রহমান এখনো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে কর্মরত রয়েছেন। পদোন্নতির আগেও তিনি একই পদে ছিলেন। সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুব শাহীন পদোন্নতির পরও একই জায়গায় এবং পদে রয়েছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলামও এখনো একই পদে কর্মরত। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী, আইএমইডির মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান, ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক পদে আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের পদোন্নতির পরও এসব পদে কর্মরত রয়েছেন। পদোন্নতির আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন মো. আবদুস সবুর ম-ল। পদোন্নতির পরও তিনি একই পদে ছিলেন। তবে সম্প্রতি তিনি এ দপ্তরের মহাপরিচালক হয়েছেন।
পদোন্নতির পরদিনই ৪৯ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সংযুক্তি দেওয়া হয়। অর্থাৎ তারা আগের স্থানেই যুগ্ম সচিবের জায়গায় অতিরিক্ত সচিব পদে পদায়িত হয়েছেন। পদোন্নতি পেলেও তাদের বেশিরভাগই আগের কাজই করছেন। মো. খালেদ হোসেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি হওয়ার পরও তিনি একই মন্ত্রণালয়ে রয়ে যান। পদোন্নতির সময় তিনি ঢাকা ওয়াসার ডিএমডি হিসেবে বদলির আদেশাধীন ছিলেন। তিনি সেখানে যোগ দেননি। অর্থ বিভাগের সাইফুল্লাহ পান্না, সুলেখা রানী বসু, তাহমিদ হাসনাত খান পদোন্নতি পাওয়ার পরও একই মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি পেয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মো. মুহিবুজ্জামানকে পদোন্নতির পরও একই মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের মো. আব্বাছ উদ্দিন, মো জহুরুল হক পদোন্নতির পরও একই মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তির আদেশ পান। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঞ্জয় কুমার ভৌমিক এবং কেয়া খান পদোন্নতির আগে যুগ্ম সচিব হিসেবে এবং পদোন্নতির পর অতিরিক্ত সচিব হিসেবে একই মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। সংস্কৃতিবিষযক মন্ত্রণালয়ের অসীম কুমার দে পদোন্নতির আগে ও পরে একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের খোরশেদা ইয়াসমীন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী অতিরিক্ত সচিব পদে সংযুক্তি পেয়েছেন। পদোন্নতির আগেও তারা একই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যুগ্ম সচিব ছিলেন।
গত ৬ এপ্রিল বুধবার ৯৪ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পরদিন এসব কর্মকর্তা ওএসডি হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছেন। গতকাল রবিবার তাদের ইনসিটু এবং সংযুক্তির আদেশ জারি করা হয়। তাদের মধ্যে ৩১ জন ইনসিটু হিসেবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, অধিদপ্তর, করপোরেশন, প্রকল্পে ঠিক আগের পদে দায়িত্ব পালন করবেন। একই দিনে ৪৮ জন কর্মকর্তার সংযুক্তির আদেশ হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘আমি অতিরিক্ত সচিব হলেও মূলত যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব পালন করছি। আমার পদোন্নতি হয়েছে, মর্যাদা বেড়েছে; কিন্তু দাপ্তরিক উন্নতি ঘটেনি। এটি না হওয়ায় সরকার আমাকে যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, আমি সেভাবে সরকারকে প্রতিদান দিতে পারছি না। এ অবস্থার স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত