চার এমপি ও মন্ত্রীর স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান সরাসরি সিন্ডিকেটে
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির কাজ সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পাওয়া ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি পেতে যাচ্ছে, তার তিনটির মালিকানায় রয়েছেন তিন এমপি। একটির মালিকানায় রয়েছেন একজন মন্ত্রীর স্ত্রী। দুই এমপির প্রতিষ্ঠান জনশক্তি ব্যবসায় একেবারেই নতুন। তার পরও তাদের প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে যাচ্ছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
ফেনী-২ আসনের সরকারদলীয় এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর প্রতিষ্ঠান স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড (লাইসেন্স নম্বর ১৫৫১) প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত মাত্র ৯১ জন কর্মী বিদেশ পাঠালেও, রিক্রুটিং এজেন্সিটি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির কাজ পেতে যাচ্ছে। সাবেক এক প্রভাবশালী আমলা প্রতিষ্ঠানটির মূল মালিক বলে জানা গেছে।
ঢাকা-২০ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি বেনজির আহমদের প্রতিষ্ঠান আহমদ ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ১১৪৬) প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ৩৮৭ জন কর্মী বিদেশ পাঠিয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর কাজ পেতে যাচ্ছে।
ফেনী-৩ আসনের এমপি ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (লাইসেন্স নম্বর ১৩২৭) চার বছর আগে ব্যবসা শুরুর পর এখন পর্যন্ত দুই হাজার ২৭১ জন কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের আলোচিত সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠানও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটে রয়েছে।
২৫ এজেন্সির তালিকায় রয়েছে অরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের (লাইসেন্স নম্বর ১১৩)। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মেয়ে কাশ্মিরি কামাল প্রতিষ্ঠানটির মালিক। এই প্রতিষ্ঠানটি জনশক্তি ব্যবসায় অনেক পুরোনো। তারা এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার ৮৮৫ জন কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে এবারও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবে মালয়েশিয়া। ২০১৫ সাল থেকে তিন বছরে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে পৌনে তিন লাখ কর্মী নিয়োগ করেছিল দেশটি। ওই তালিকা থেকে এবার ছয়টি এজেন্সি এবার বাদ পড়েছে। বাকি চারটির একটি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ৫৪৯) এবারও রয়েছে ২৫ এজেন্সির তালিকায়। বাকি তিনটি এসেছে ভিন্ন নামে।
ক্যাথারসিসের মালিক রুহুল আমিন স্বপন জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সির সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব। যাঁরা সীমিত সংখ্যক এজেন্সি বা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর বিরোধিতা করছেন তাঁদের অভিযোগ, রুহুল আমিন স্বপনই সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রক। আগেরবার ১০ এজেন্সির নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। এবারও ২৫ এজেন্সির নিয়ন্ত্রক তিনি।
আগের বারের ১০ এজেন্সির তিনটি এবার ভিন্ন নামে সিন্ডিকেটে এসেছে। গতবার সিন্ডিকেটে ছিল আল ইসলাম ওভারসিস (লাইসেন্স নম্বর ১০৬)। এবার প্রতিষ্ঠানটির মালিক জয়নাল আবেদিন জাফরের ছেলে রাশাদ আবেদিনের প্রতিষ্ঠান এসওএস ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস (লাইসেন্স নম্বর ১৫৩০) রয়েছে ২৫ এজেন্সির তালিকায়। জয়নাল আবেদিন জাফর সমকালকে বলেছেন. পড়াশোনা শেষে ছেলে ব্যবসার হাল ধরেছে। তাই ছেলের প্রতিষ্ঠানের নামে এবার কর্মী পাঠাবেন।
২০১৫ সালের সিন্ডিকেটে ছিল শানজারি ইন্টান্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ৭৪২)। তার বদলে এবার এসেছে নিজাম হাজারীর স্নিগ্ধা ওভারসিস লিমিটেড। প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটসের (লাইসেন্স নম্বর ৪৬৮) বদলে এসেছে অর্থমন্ত্রীর স্ত্রীর নামে করা প্রতিষ্ঠান অরবিটাল।
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ- সূত্রে সম্ভাব্য ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেটে কোন কোন এজেন্সি থাকছে, তার তালিকা পেয়েছে সমকাল। মালয়েশিয়ার ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমেও (এফডব্লিওসিএমএস) এই ২৫ এজেন্সির নাম ছিল। যদিও সম্প্রতি তা মুছে দেওয়া হয়েছে।
চার এমপি ও মন্ত্রীর স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান ছাড়াও তালিকায় নাম রয়েছে আবেদ এয়ার ট্রাভেল এন্ড ট্যুরস (লাইসেন্স নম্বর ১০২৪), আকাশ ভ্রমণ (লাইসেন্স নম্বর ৩৮৪), আল রাবেতা ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ৩৫৪), আল বুখারি ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ৩০১), অ্যামিয়াল ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ১৩২৬), বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ৩৫১), বিএম ট্রাভেলস (লাইসেন্স নম্বর ১৪২১), ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ১৫৭১), গ্রিনল্যান্ড ওভারসিস (লাইসেন্স নম্বর ৪০), ইম্পেরিয়াল রিসোর্স (লাইসেন্স নম্বর ১৮৭৪), ইরভিং এন্টারপ্রাইজ (লাইসেন্স নম্বর ২১৫), ঐচি ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ১১৪১), পাথ ফাইন্ডার (লাইসেন্স নম্বর ১২৯৮), সরকার ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ১৭১৫), শাহীন ট্রাভেল (লাইসেন্স নম্বর ২১৪), সাউথ পয়েন্ট ওভারসিস (লাইসেন্স নম্বর ৬২২), ইউনাইটেড ম্যানপাওয়ার (লাইসেন্স নম্বর ১২১৬), জাহারাত অ্যাসোসিয়েট (লাইসেন্স নম্বর ২৮৫) এবং নিউএজ ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ৭০৩) আগেরবার ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেটে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাদ পড়েছে সেগুলো হলো আমিন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস (লাইসেন্স নম্বর ৯৮১), ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড (লাইসেন্স নম্বর ২১), রাব্বি ইন্টান্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর ২৫৮), ক্যারিয়ার ওভারসিস রিসোর্স (লাইসেন্স নম্বর ৪০৩), আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স (লাইসেন্স নম্বর ১১৯৪) এবং প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম (লাইসেন্স নম্বর ৩১০)।
রাব্বি ইন্টান্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ বশির বলেছেন, আগেরবার জিটুজি প্লাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে অনৈতিক ব্যবসা করা হয়েছে। সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠানোর বিষয়টিই অনৈতিক। সে কারণে এবার তিনি এতে থাকছেন না।
বাদ পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক মালিক বলেছেন, আগেরবার মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত ব্যয় প্রথমে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৭ হাজার টাকা। পরে তা বাড়িয়ে করা হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু কর্মীপ্রতি তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে।
একজন এজেন্সি মালিক বলেন, নামে ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট হলেও ব্যবসা ও মুনাফা করেছে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। বাকিরা নানাভাবে ছিল কোণঠাসা। মুনাফা করার বদলে লোকসান করেছে। কিন্তু কলঙ্কের ভাগীদার হয়েছে। এই মালিক জানান, তাঁরা কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র আনলেও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকদের ঘুষ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের চাহিদাপত্রের বিপরীতে মালয়েশিয়ায় অনলাইন সার্ভারে নিয়াগ অনুমতি ‘পুটআপ’ করা হতো না। একটি জাপানি প্রতিষ্ঠান থেকে ৭৫০ জন কর্মী নিয়োগের চাহিদা এনেছিলেন। তা নিয়ে যায় সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকরা। সে কারণে এবার তিনি আর সিন্ডিকেটে থাকতে আগ্রহী নন।
নানা অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। মানব পাচার বেড়ে গেলে দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে ২০১৫ সালে সমঝোতা স্মারক সই করে দেশটি। জিটুজি প্লাস নামে পরিচিত ওই সমঝোতা স্মারকের অধীনে ১০টি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দিয়েছিল মালয়েশিয়া। সেবার দুই দফায় ৯৩০টি এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে ১০ প্রতিষ্ঠানকে কীসের ভিত্তিতে কোন মাণদণ্ডে বাছাই করা হয়েছে, তার জবাব কখনও দেয়নি মালয়েশিয়া। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়া কর্তৃক এজেন্সি বাছাইয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সিন্ডিকেটে থাকা এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীনদের ঘুষ দিয়ে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
২০১৮ সালে মাহাথির মুহাম্মদ সরকার ক্ষমতায় ফিরে জিটুজি প্লাসে কর্মী নিয়োগ বাতিল করে। সেই থেকে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। আবার তা খুলতে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক সই করেছে দুই দেশ। আগের অভিজ্ঞতায় এবার ছিল, সব এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেওয়া হোক। কিন্তু গত ১৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভান প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদকে চিঠিতে জানান, ২৫ এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ করবে তাঁর দেশ। প্রতিটি এজেন্সির অধীনে ১০টি করে সাব-এজেন্সি কর্মী পাঠাতে পারবে। এজেন্সি বাছাই করবে মালয়েশিয়ার সরকার। ১৭ জানুয়ারি ফিরতি চিঠিতে বাংলাদেশ জানায়, প্রতিযোগিতা আইনের কারণে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে পারে না বাংলাদেশ। সব প্রতিষ্ঠানকে সমান সুযোগ দিতে হবে।
সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট, নাকি সবাই পাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ- এ নিয়ে ব্যবসায়িক টানাপোড়েনে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর ছয় মাসেও খোলেনি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো হবে, তা নির্ধারণে গত বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপর (জেডব্লিউজি)।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ সিন্ডিকেটের বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করে বলেছেন, সব বৈধ এজেন্সির তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া যাদের বাছাই করবে, সেসব এজেন্সিই কর্মী পাঠাবে। তবে জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই বাছাইয়ের মাধ্যমেই সিন্ডিকেট হবে। ২০১৫ সালে যেমন হয়েছিল।
সূত্র: সমকাল
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত