ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ চলবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত
কার ব্যস্ততম সড়কগুলোর একটি মিরপুর-ফার্মগেট-মতিঝিল সড়ক। ২০১৭ সালে এ সড়কে শুরু হয় মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। শুরুর পর থেকে দিন যত গড়িয়েছে, তত বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ। সংকুচিত হয়ে যাওয়া রাস্তা, ফেলে রাখা নির্মাণসামগ্রী আর খোঁড়াখুঁড়িই এ দুর্ভোগের কারণ। জলাবদ্ধতা, অসহনীয় যানজট বর্তমানে রাজধানীর অন্যতম প্রধান এ সড়কটির নিত্যসঙ্গী, যা প্রভাব ফেলছে ঢাকার অন্যান্য সড়কেও। মেট্রোরেলের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে। ততদিন দুর্ভোগ সঙ্গী করেই সড়কটি ব্যবহার করতে হবে ঢাকাবাসীকে।
বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কে চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের নির্মাণকাজ। ঢাকা-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়কের ঢাকা-গাজীপুর অংশে পড়েছে এ প্রকল্প। সড়কটির মাঝখান দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিআরটি লেন। যান চলাচলের জায়গা কমে আসায় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই যানজট লেগে থাকে এ সড়কে। সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা, যা যানজট পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলে। ২০১৭ সালে বিআরটির নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকে বেহাল দশায় চলে গেছে সড়কটি।
যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে ঢাকাবাসী এমন দুর্ভোগ থেকে সহসাই মুক্তি পাচ্ছে না। উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল ছাড়াও ঢাকায় আরো পাঁচটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এগুলো সম্পন্ন হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, ঢাকার সবক’টি মেট্রোরেলের কাজ শেষ করতে আরো কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। ২০২৭ নাগাদ তৈরি হওয়ার কথা আরেকটি বিআরটি লেন। ঢাকা এবং ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ সম্পন্ন হতে লেগে যাবে আরো কয়েক
বছর। পরিকল্পনাধীন তিনটি রিংরোড, ৮১ কিলোমিটারের বৃত্তাকার রেল, ২৫০ কিলোমিটারের বেশি সাবওয়ে নেটওয়ার্কের নির্মাণ শেষ হবে ২০৫০ সালে। অর্থাৎ ঢাকাবাসীকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত চলমান উন্নয়নকাজের দুর্ভোগ সঙ্গী করেই চলাচল করতে হবে।
বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকার যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো মানুষকে দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ঢাকায় সড়ক কম, গাড়ি বেশি। স্বাভাবিকভাবে চলতে-ফিরতেই মানুষের অনেক দুর্ভোগ হয়। এর মধ্যে একসঙ্গে যদি অনেকগুলো সড়কের ওপর উন্নয়নকাজ চলে, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আমরা কিন্তু সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের উচিত ছিল বিক্ষিপ্তভাবে প্রকল্প না নিয়ে সমন্বিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। একটা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আরেকটির কাজ শুরু করা। তা না করে আমরা একসঙ্গে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
বর্তমানে ঢাকায় একটি মেট্রোরেল লাইনের কাজ চলমান। ২০২২ সাল নাগাদ ঢাকায় আরো দুটি মেট্রোরেল লাইনের কাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে বিমানবন্দর-কমলাপুর, বিমানবন্দর-পূর্বাচলে নির্মাণ হবে এমআরটি-১। আমিনবাজার-গাবতলী থেকে নতুনবাজার-ভাটারায় নির্মাণ হবে এমআরটি-৫। বিদ্যমান সড়কগুলোর পাতাল ও উড়ালপথে নির্মাণ করা হবে এগুলো। লাইন দুটির একটি বড় অংশ হবে পাতালপথে। কিছু অংশ তৈরি হবে উড়ালপথে। যথাক্রমে ২০২৬ ও ২০২৮ সাল নাগাদ প্রকল্প দুটি শেষ হওয়ার কথা। কাজ শুরু হলে আমিনবাজার-গাবতলী-নতুনবাজার-ভাটারা, বিমানবন্দর-কমলাপুর ও নতুনবাজার-পূর্বাচল সড়কে যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়বে ঢাকাবাসী। একইভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে আশুলিয়া-সাভার-গাবতলী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে কমলাপুরে এমআরটি-২ ও কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে এমআরটি-৪-এর নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখবে ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ।
মেট্রোরেলের কাজ শেষ হওয়ার আগেই সাবওয়ের কাজ শুরু করতে চায় সেতু কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০২ কিলোমিটার, ২০৪০ সালের মধ্যে আরো ৮৫ কিলোমিটার এবং শেষ ধাপে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭১ কিলোমিটার সাবওয়ে লাইন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানায় সংস্থাটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হলে ১১টি সাবওয়ের নির্মাণকাজে দীর্ঘদিনের জন্য দুর্ভোগে পড়বে ঢাকাবাসী।
বর্তমানে বিমানবন্দর-গাজীপুরে একটি বিআরটি লেনের কাজ চলমান। ২০২৭ সালের মধ্যে গুলিস্তানের মধ্যে আরেকটি বিআরটি লেন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। কাজ শুরু হলে গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ সড়কে যাতায়াতও কঠিন হবে উঠবে। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। মেয়াদ ২০২২ সাল পর্যন্ত হলেও দেরিতে শুরু করার কারণে শেষ করতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। নির্মাণকাজ চলাকালে সাভার-আশুলিয়া-বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর-বিমানবন্দর সড়কে যাতায়াতে দুর্ভোগে পড়বে ঢাকাবাসী।
তবে এ প্রকল্পের কাজ চলাকালে মানুষ যেন খুব বেশি দুর্ভোগে না পড়ে সেজন্য বিকল্প সড়কের সংস্থান রাখার কথা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক। তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পে জনভোগান্তি হয়েছে। এটা মাথায় রেখেই আমরা ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলাকালে একটি বিকল্প সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি। নির্মাণকাজ চলাকালে যানবাহনগুলো সড়কটি ব্যবহার করবে। এ উদ্যোগ জনভোগান্তি লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকাকে ঘিরে ৮১ কিলোমিটারের একটি বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরই মধ্যে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও করেছে সংস্থাটি। ৭১ কিলোমিটার উড়ালপথে, ১০ কিলোমিটার পাতালপথের এ বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন না হলেও ২০৩৫ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নির্মাণকাজ শুরু হলে প্রকল্পটিও দীর্ঘদিনের জন্য ঢাকাবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসবের বাইরে ঢাকায় একাধিক রিংরোড, ফ্লাইওভার-ওভারপাস, ফুটপাত-ফুটওভারব্রিজসহ যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে নানাবিধ প্রকল্প চলমান ও পরিকল্পনাধীন অবস্থায় রয়েছে। এসব প্রকল্পের কারণেও দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ।
উন্নয়ন প্রকল্পে জনদুর্ভোগের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) নীলিমা আখতার বলেন, ঢাকায় যানজট পরিস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান যানবাহনের চাপে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা অনেক চ্যালেঞ্জের। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনভোগান্তি সবচেয়ে কম পর্যায়ে রাখার বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তার পরও বাস্তবে দেখা যায়, উন্নয়নকাজের কারণে মানুষের ভোগান্তি হয়। মেট্রোরেল, বিআরটি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সাবওয়ে, সার্কুলার রেলের মতো অনেকগুলো বড় প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন ও ভবিষ্যতে বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। জনভোগান্তি সবচেয়ে কম মাত্রায় রেখে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। আমরা সেই কাজটিই করে যাচ্ছি।
সূত্র: বণিক বার্তা
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত