তরমুজের পিস মাত্র ২০ টাকা, তবুও ক্রেতা নেই
নাটোরের বড়াইগ্রামের মাড়িয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী কৃষক আব্দুল মজিদ (৫২)। বৃহস্পতিবার বিকালে কিছু তরমুজ নিয়ে বিক্রির আশায় বসেছিলেন বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের ধারে। একজন যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ধরে আছেন, কিন্তু তিনি হাত বাড়িয়ে না নিয়ে উদাসভাবে বসে আছেন।
সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল যুবকটির হাতে একটি হালখাতার কার্ড। তরমুজের জমিতে সেচ দেওয়ার পাঁচ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে, তারই হালখাতা। কিন্তু টাকা কোথা থেকে দেবেন এ দুশ্চিন্তায় কার্ডটি না ধরে নির্বাক বসে আছেন তিনি।
কথা বললে তিনি জানান, দুই বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করেছিলেন তিনি। ঈদের আগে এক চালান তরমুজ এক হাজার ৩০০ টাকা প্রতি ১০০ তরমুজ বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু ঈদের পর দাম না থাকায় তরমুজ বেচে ঈদের আগে ও পরে মিলিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা পেয়েছেন তিনি। সেসব টাকা সার-কীটনাশকের দোকানসহ শ্রমিক খরচ দিতেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সেচের বকেয়া টাকা দেবেন কোথা থেকে সেটি নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তিনি।
শুধু আব্দুল মজিদই নন, তার মতো বড়াইগ্রামের শত শত তরমুজ চাষির একই অবস্থা। বর্তমানে জমি থেকে কৃষকরা ৬-১০ কেজি আকারের একেকটি তরমুজ বিক্রি করছেন মাত্র ২০-২৫ টাকা দরে। আর ২-৩ কেজি আকারের তরমুজের দাম মাত্র ৬-৭ টাকা। এসব তরমুজ জমি থেকে তুলে রাস্তা পর্যন্ত আনতে প্রতিটির জন্য আবার ৫-১৫ টাকা পর্যন্ত শ্রমিক খরচ দিতে হচ্ছে।
এতে চাষিদের উৎপাদন খরচ তো উঠছেই না, উল্টো লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। আর যারা জমি লিজ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন, বিঘা প্রতি তাদের লোকসান আরও বেশি। এতে এ এলাকার তরমুজ চাষিরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
মাড়িয়া গ্রামের কৃষক শরীফুল ইসলাম জানান, তিনি এবার ছয় বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। এতে তার এক লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। কিন্তু জমির তরমুজ বেচে পেয়েছেন মাত্র ৮০ হাজার টাকা।
বাজিতপুর গ্রামের কৃষক সোরাবুল ইসলাম জানান, তিনি ঈদের আগে ১২ হাজার টাকা শ হিসেবে একশ’টি তরমুজ বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু এখন বেপারিরা প্রতি শ’ তরমুজের দাম ২০০০-২৫০০ টাকার বেশি বলছেই না। বৃহস্পতিবার তিনি সবচেয়ে ভালো তরমুজ বিক্রি করেছেন আড়াই হাজার টাকা শ’ হিসাবে।
অপেক্ষাকৃত ভালো দাম পাওয়া কৃষক মাড়িয়া পূর্বপাড়ার রবিউল করিম জানান, তিনি এবার রোজার মধ্যে তরমুজ বিক্রি করে বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকার মতো পেয়েছেন। এতে তার খরচ উঠে কিছু টাকা লাভ হয়েছে। কিন্তু গত মৌসুমে তিনি তরমুজ বিক্রি করে বিঘাপ্রতি এক লাখ টাকারও বেশি দাম পেয়েছিলেন।
একই এলাকার কৃষক সবুজ হোসেন বলেন, এবার প্রচণ্ড খরার কারণে তরমুজের ফলনও ভালো হয়নি, আকারও ছোট হয়েছে। তার ওপর শুরু হয়েছে বৃষ্টি। এতে বেপারিরা আর তরমুজ কিনতে চাচ্ছেন না। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা টেলিভিশনে খবর দেখি যে, ঢাকায় প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা দামে। অথচ আমরা ৭-৮ কেজি আকারের একটি তরমুজ বিক্রি করছি মাত্র ২০ টাকায়। এত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে তাহলে আমাদের কী লাভ।
দাম কমে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহীর বাঘা থেকে আসা তরমুজের বেপারি ইয়াকুব আলী বেপারি বলেন, রোজা শেষ হয়ে যাওয়া, বৃষ্টি, লিচুসহ আম উঠতে শুরু করার কারণে বাজারে তরমুজের চাহিদা কমে গেছে। আমি তরমুজ কিনে কুমিল্লা, সিলেট, হবিগঞ্জ ও নরসিংদীর আড়তে পাঠাই। কিন্তু আড়তদাররা তরমুজ পাঠাতে নিষেধ করছে। আমরা বেপারিরা কি করব বলুন। তার পরও আজ ২০০০-২৫০০ টাকা শ’ হিসাবে কিছু তরমুজ কিনেছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা বলেন, এ বছর উপজেলায় ৪২০ হেক্টর জমিতে তরমুজ ও ১২০ হেক্টর জমিতে বাঙ্গির চাষ হয়েছে। প্রথম দিকে একটু ভালো দাম পেলেও ঈদের পরে কৃষক একেবারেই দাম পাচ্ছে না। এতে লোকসানে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত