দায়ীদের শনাক্তের নির্দেশ
জাতীয় পুরস্কারসংক্রান্ত কমিটির কাছে তথ্য গোপন করায় দায়ীদের শনাক্তের নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। চলতি বছর যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আমির হামজাকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করা হয়। ঘটনা প্রকাশ হলে পুরস্কারটি বাতিল করে সরকার।
জানা গেছে, আমির হামজার নাম সুপারিশ করেছিলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তাকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি ১৬ জন সচিবের সমন্বয়ে গঠিত ‘প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটি’র সদস্য হিসাবেও আছেন।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, উপসচিব আছাদুজ্জামান মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে কিছু করার সুযোগ নেই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে লিখব। তারা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কবে কিভাবে চিঠি দেব এখনো ঠিক হয়নি। হয়তো দু-এক দিন সময় লাগবে। মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সচিবালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছেন, স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো বিষয়ে যারা অবহেলা করেছেন এবার তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। দু-একজনের খামখেয়ালির জন্য পুরো আমলাতন্ত্রকে দায় হতে হচ্ছে। প্রশাসনের সব স্তর থেকেও এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ঘটনার দায় নিরূপণের জন্য উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা সংশ্লিষ্টরা দিতে পারছেন না। শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আগে দায় নিরূপণ হোক পরে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কারণ এ ধরনের কর্মকর্তার কারণে সরকারপ্রধানকেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। পুরস্কারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। যারা তথ্য দিয়ে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাদের প্রতি ব্যবস্থা না নিলে এমন ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে। এ সময় আলোচনায় আসে ২০২০ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য রইজ উদ্দীনের নাম প্রস্তাব করা সাবেক যুগ্মসচিবের নাম। সেবারও চূড়ান্ত ঘোষণার পর তার নাম বাতিল হয়। ওই উদাহরণ টেনে এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সে বছর কড়া পদক্ষেপ নিলে এবার এ ধরনের সমালোচনার মুখে পড়তে হতো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের বিষয়টিকে দুর্ঘটনা ভেবে অনেকেই এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় বিশিষ্টজনরাও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুউদ্দিন চৌধুরী মানিক যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ পুরস্কার দেওয়ার জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়াটাই ত্রুটিপূর্ণ। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়া বাতিল করে এ সংক্রান্ত কমিটিও পুনর্গঠন করতে হবে। সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রস্তাবকারী সচিবের দায় অবশ্যই আছে। কোনো বিষয়ে সুপারিশ করার আগে একজন সিনিয়র সচিব কিছুই জানবেন না এটা হতে পারে না। সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক কার নামে সুপারিশ করছেন, লেখক বা কবি হিসাবে তার নাম আগে শুনেছেন কিনা, না শুনলে তার লেখা অন্তত তিনি পড়ে দেখতে পারতেন। ফাওজুল কবির বলেন, তিনি যদি বুঝে-শুনেই প্রস্তাব করে থাকেন, তাহলে শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে একজন সিনিয়র সচিবের জানার পরিধি আমাদের ব্যথিত করবে।
আমির হামজাকে মনোনীত করার বিষয়টি তার নিজেরসহ পুরো কমিটির ব্যর্থতা বলে দায়িত্ব শিকার করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বুধবার নিজ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত অন্য একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী বলেছেন, কমিটির দায়িত্ব পালনে নিশ্চয়ই ত্রুটি হয়েছে। নইলে এ ভুল হলো কেন? এটা যেমন আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা এবং তেমনই কমিটিরও যৌথ ব্যর্থতা। সাংবাদিকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, যে কোনো শক্তির চেয়ে কলমের শক্তি বেশি। এটা আপনারা প্রমাণ করেছেন। আপনাদের লেখনীর মধ্য দিয়ে সত্য প্রকাশ হয়েছে। আমরা ভুল করলে ভুল সংশোধন করি। ভুল হতে পারে, মানুষ হিসাবে আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আমাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। মন্ত্রী বলেন, অনেক সত্য গোপন করা হয়েছিল। আমাদের যেটা ভুল হয়েছে সেটা সংশোধন করেছি। আমরা কেউ চাইব না বারবার ভুল করতে।
১৫ মার্চ ১০ ব্যক্তি ও ১ প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করে স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সাহিত্যে আমির হামজার পুরস্কার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ৪ দিনের মাথায় পুরস্কারের সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে সরকার। প্রয়াত আমির হামজার বাড়ি মাগুরার শ্রীপুরে, তিনি মাত্র দুটি বই লিখেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ শীর্ষক দুটি বই প্রকাশ হয়েছে পর্যায়ক্রমে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালে। আমির হামজার মেজ ছেলে খুলনা জেলা পরিষদের সচিব মো. আছাদুজ্জামান। তিনিই তার বাবার জন্য এ পুরস্কারের আবেদন করেন। আর তাতে সুপারিশ করেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
সূত্র: যুগান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত