দেশে তৈরি হয়েও মোবাইলের দাম কমলো না

| আপডেট :  ১৭ মে ২০২২, ০৫:৫২  | প্রকাশিত :  ১৭ মে ২০২২, ০৫:৫২

১৫টি মোবাইল কোম্পানির উৎপাদন ও অ্যাসেম্বলিং কারখানা এখন বাংলাদেশে। তারপরও কমছে না দাম। সরকারের বিভিন্ন ধরনের শুল্ক সুবিধা নিলেও বিদেশ থেকে আমদানি করা মোবাইলের মতোই দাম রাখছে কোম্পানিগুলো। মোবাইলে ডাটা ব্যবহারকারীদেরও অভিযোগের শেষ নেই। দেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়লেও সেবার মান নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ।

এ পরিপ্রেক্ষিতেই মঙ্গলবার (১৬ মে) দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস। ‘বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যসম্মত বার্ধক্যের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে।

জানা যায়, দেশে ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন শুরু করেছে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান। গত অর্থবছর প্রায় ৪ কোটি ১২ লাখ হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও আমদানি হয়েছে। উৎপাদন হওয়া সেটের প্রায় ৬০ শতাংশই হয়েছে দেশে। এছাড়া অবৈধপথে হ্যান্ডসেট আমদানির সংখ্যাও কম নয়। এর পরিমাণও প্রায় ২০ শতাংশ।

‘মেড ইন বাংলাদেশ’ গ্রাহকদের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না দাবি করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, সরকার মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন উৎসাহিত করে রপ্তানি করা ও দেশে সস্তায় হ্যান্ডসেট দিতে আমদানি করা হ্যান্ডসেটের ওপর কর বাড়ায়। অন্যদিকে দেশি উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দেয়। যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা হ্যান্ডসেটের ওপর ৭৫ দশমিক ৩১ শতাংশ কর সেখানে উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে করহার ধার্য করা হয় মাত্র ১৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিম্ফনি মোবাইলের ম্যানেজার (পাবলিক রিলেশন্স) মো. রুপক বলেন, মাঝখানে সব ফোনেরই দাম কমেছিল। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে বাংলাদেশে আমাদের ৬০ বা ৭০ শতাংশ রেডি করতে হয়। কিছু জিনিসের জন্য তো আমাদের চায়নার উপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। চায়নাতে এসব জিনিসের দাম বেশি। এটা আসলে আমাদের করার কিছু নেই। কারণ এখন ডলারের দামও বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান
ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের প্রতিষ্ঠান- ওকলার তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৪২ দেশের মোবাইল ইন্টারনেট গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। গত বছরের তুলনায় ছয় ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিকভাবে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি হলো ডাউনলোডের জন্য ২৯ দশমিক ৯৬ এমবিপিএস আর আপলোডিংয়ের জন্য ৮ দশমিক ৭০ এমবিপিএস। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমান গতি রয়েছে ১০ দশমিক ৪৩ এমবিপিএস। এ তালিকার প্রথমেই রয়েছে ইউনাইটেড আরব আমিরাত। দেশটিতে মোবাইল ইন্টারনেটের স্পিড ১৩৫ দশমিক ৩৫ এমবিপিএস।

আর তালিকার সবশেষ এবং ১৪২তম তালিকায় রয়েছে প্যালেস্টাইন। দেশটির ইন্টারনেট স্পিড মাত্র ৪ দশমিক ৮৯। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে লিবিয়া, তানজানিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ, আইভরিকোস্ট, সুদান, কুবা, ঘানা, সোমালিয়া, তাজিকিস্তান, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান ও প্যালেস্টাইন। বাংলাদেশের সামনে তালিকার ১২০তম স্থানে রয়েছে পাশের দেশ ভারত তার নিচে আছে উজবেকিস্তান, সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা, হাইতি, আলজেরিয়া, কলম্বিয়া, কঙ্গো ও ক্যামেরুন।

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট মোবাইল সংযোগ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি দুই লাখ ৯২ হাজার জনে। এর মধ্যে গ্রামীনফোনেরই রয়েছে ৮ কোটি ৩ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক। এছাড়া রবি আজিয়াটার ৫ কোটি ৪ লাখ সাত হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৮ লাখ নয় হাজার ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার টেলিটকে রয়েছে ৬০ লাখ ৮৯ হাজার গ্রাহক।

একই সময়ে দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সবশেষ ৯০ দিনে একবার ইন্টারনেটে সক্রিয় হলেই তাকে গ্রাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৪ লাখ ৮৯ হাজার। এর মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাই ১১ কোটি ৩ লাখ ৯০ হাজার এবং ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৯ হাজার। দিন দিন এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় সেবার মান বাড়েনি। খোদ রাজধানীতেই রয়েছে নেটওয়ার্ক সমস্যা। কলড্রপ, অযাচিত ফোনকল, দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যা। এসব বিষয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই।

সমস্যার কথা স্বীকার করে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের দেশে মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা আছে। আমরা ২০১৮ সালে ফোরজির যুগে পৌঁছেছি। এর আগে টু-জি আর থ্রি-জির যুগে ছিলাম। টু-জিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেত না আর থ্রি-জিতে সীমিত পর্যায়ে ব্যবহার করা যেত। তাতে সারাবিশ্বের সঙ্গে যখন তুলনা করা হয় তখন আমারতো গতি থাকবেই না।

মন্ত্রী বলেন, আমার প্রযুক্তির গতি না থাকলে গ্রাহককে আমরা গতি দেবো কীভাবে? আমরা ২০১৮ সালে ফোরজি চালু করেছি। এরপর ২০২১ সালে তরঙ্গ নিলাম করেছি। তখন করোনার মধ্যে ছিলাম। ফলে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের যে বিষয়টি ছিল সেটি করা সম্ভব হয়নি। অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৮ শতাংশ অঞ্চলে ফোরজি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেও গ্রাহককে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ফোরজির জন্য আপডেট করতে হবে সিম ও হ্যান্ডসেট। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত ৪০ শতাংশের উপরে স্মার্টফোন নিউট্রেশন করতে পারিনি। ফলে ব্যবহারকারীর কাছে যে গতিটা দেবো সেটি গ্রহণ করার যন্ত্রটাও তো তার কাছে থাকতে হবে। আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি। তাতে মনে হয়েছে তরঙ্গ যদি থাকে তাহলে সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। অপারেটররা এর আগে ১৫৬ মেগাহার্জ তরঙ্গ নিয়েছিল। গত ৩১ মার্চ আমরা আরও ১৯০ মেগাহার্জ তরঙ্গ নিলাম করেছি। এই তরঙ্গটা নেটওয়ার্কে দিলে গতি ফিরে আসবে।

ইন্টারনেটের দাম
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) ও বৈশ্বিক ইন্টারনেট ফোরাম অ্যালায়েন্স ফর অ্যাফোর্ডেবল ইন্টারনেটের (এফোরএআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের দামের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে বাংলাদেশ।‘দ্য অ্যাফোর্ডেবিলিটি অব আইসিটি সার্ভিসেস ২০২১’ নামের প্রতিবেদনটি চলতি বছরের ১৭ মার্চ প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল ইন্টারনেটের দামের ক্ষেত্রে গত বছর জাতিসংঘের ব্রডব্যান্ড কমিশনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে বিশ্বের ৯৬টি দেশ। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দামের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে ৬৪টি দেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের বেশির ভাগ স্বল্পোন্নত দেশে ইন্টারনেটের দাম জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশসহ মাত্র চারটি দেশ জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। এ তালিকার বাকি তিন দেশ হলো ভুটান, মিয়ানমার ও নেপাল।

আইসিটি সেবার সক্ষমতা শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রতি দুই জিবি মোবাইল ডেটাভিত্তিক ইন্টারনেটের জন্য মাসিক মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ব্যয় হয়, যার মূল্য ২ দশমিক ৩২ ডলার। ক্রয় ক্ষমতার সমতার হিসাবে এ ব্যয় ৫ দশমিক ৯৮ ডলার। মোবাইল ইন্টারনেটের সাশ্রয়ী দামে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা।

বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জিবি তারযুক্ত অর্থাৎ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের জন্য মাসিক মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ব্যয় হয়, যার মূল্য ৩ দশমিক ৩৯ ডলার। ক্রয়সক্ষমতার সমতার হিসাবে এ ব্যয় ৮ দশমিক ৭৩ ডলার। ব্রডব্যান্ডে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ব্যয় কম।

অবশ্য ইন্টারনেটের দাম পর্যালোচনাকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেবল ডট সিও ডট ইউকের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২৩০টি দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের কম দামের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ নম্বরে।

তবে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ভালো সেবার জন্য ভালো ফাইবার আর তরঙ্গের দরকার। আমরা এবার যে তরঙ্গ কিনেছি সেগুলো এখনো ব্যবহার করা হয়নি। গতবারের তরঙ্গ এবার ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও একবছর সময় লাগবে। এরপর হয়তো গ্রাহকরা ভালো সেবা পাবেন।

কলড্রপের ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কলড্রপ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের (২ শতাংশ) মধ্যেই রয়েছে। এরপরও আমরা ক্ষতিপূরণ দেই।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত