দেশে সবচেয়ে কম গরিব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুরে
দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়লেও উত্তরবঙ্গে দারিদ্র্য পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে বেশি গরিবের সংখ্যা কুড়িগ্রামে। এই জেলার প্রতি ১০০ জনের ৭১ জনই গরিব।
এর মধ্যে জেলার রাজীবপুর উপজেলার ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষই দরিদ্র। এর পরে আছে বান্দরবানের থানছি উপজেলা। এখানে দারিদ্র্যের হার ৭৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দারিদ্র্য মানচিত্রে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএস উপজেলাভিত্তিক এই দারিদ্র্য মানচিত্র তৈরি করেছে। যাতে এসব ডেটা ব্যবহার করে দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। দেশের ৪৯২টি উপজেলার সঙ্গে মেট্রোপলিটন এলাকার ৮৫ থানাকে উপজেলা হিসাব করে ৫৭৭ উপজেলার দরিদ্র মানুষের তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে এই মানচিত্রে।
গতকাল রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) কার্নিভাল হলে ‘পোভার্টি অ্যান্ড আন্ডারনিউট্রিশন ম্যাপস বেজড অন স্মল এরিয়া এস্টিমেশন টেকনিক’ শীর্ষক এক সেমিনারে দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করা হয়। বিবিএস ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে জানানো হয়, অপুষ্টি কমানোর ক্ষেত্রে যেসব দেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ শিশুদের খর্বাকৃতির হার ১৪ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে। খর্বাকৃতির
হার ২০১৩ সালে ছিল ৪২ শতাংশ, ২০১৯ সালে তা কমে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এ তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ খর্বকায় শিশুর হার বেশি সুনামগঞ্জে, ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে কম খর্বকায় শিশুর জন্ম মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ায়, ১৫ শতাংশ। শিশুদের অপুষ্টির অবস্থা নির্দেশে তিনটি পরিমাপক ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো উচ্চতা, ওজন ও বয়স। ৬০ মাসের কম বয়সী শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
সেমিনারে জানানো হয়, বাংলাদেশে গড় দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ১১৫টি উপজেলা অতিদরিদ্র। উপজেলার সংখ্যায় দারিদ্র্যের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য দেখা যায় চট্টগ্রাম বিভাগে। অতি নিম্ন দারিদ্র্যের হার গ্রুপে বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের কোনো উপজেলা নেই। এ তালিকায় রংপুর ও সিলেট বিভাগের একটি করে উপজেলা রয়েছে। ঢাকা বিভাগের ৭৭টি উপজেলা-মেট্রো থানায় রয়েছে অতিনি¤œ দারিদ্র্য হার গ্রুপে। একই সঙ্গে এ বিভাগে ১২টি উপজেলা রয়েছে অতি উচ্চ দারিদ্র্য হার গ্রুপে।
দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করে বিবিএস জানিয়েছে, দেশের সবচেয়ে থেকে কম গরিব মানুষের বসবাস ঢাকা নগরীর গুলশানে। এখানে দারিদ্র্যের হার মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।
দারিদ্র্য মানচিত্রের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের প্রতিটি উপজেলায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। রাজীবপুরের পরেই সবচেয়ে বেশি গরিব রৌমারিতে ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এর পরে চিলমারিতে ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ, নাগেশ্বরীতে ৭২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, কুড়িগ্রাম সদরে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ, ভূরুঙ্গামারীতে ৭১ দশমিক ৯ শতাংশ, উলিপুরে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ, রাজারহাটে ৭০ দশমিক ১ শতাংশ ও ফুলবাড়ীতে ৬৯ শতাংশ মানুষ গরিব।
উত্তরবঙ্গের আরেক জেলা দিনাজপুরে প্রতি ১০০ জনে ৬৪ জনই দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।
তবে জেলার হিসাবে ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জে গরিবের সংখ্যা সবচেয়ে কম। এ জেলায় গড়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ দরিদ্র।
মানচিত্রের তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, এই বিভাগের ভোলার দৌলতখান উপজেলায় দারিদ্র্যের হার কম, মাত্র ১২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় দারিদ্র্যের হার বেশি, ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এই বিভাগে সব থেকে কম দারিদ্র্য চট্টগ্রাম সদরে, মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঢাকা বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৬ শতাংশ। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় বেশি, ৬১ দশমিক ২ শতাংশ। খুলনা বিভাগে গড় দারিদ্র্যের ২৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, এই বিভাগের চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় দারিদ্র্যের হার কম, ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। বেশি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায়, ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ।
এ ছাড়া ময়মনসিংহে দারিদ্র্যের হার ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ময়মনসিংহের ভালুকার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ গরিব। এই বিভাগে বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায়, ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র্যের হার ২৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ, এই বিভাগে কম দারিদ্র্য রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলায়, মাত্র ৯ শতাংশ, বেশি নওগাঁর পোরশায় ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ। রংপুরে গড় দারিদ্র্য ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। সব থেকে কম দরিদ্রপ্রবণ এলাকা পঞ্চগড়ের অটোয়ারী ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। সিলেটে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, এই বিভাগে কম দরিদ্রপ্রবণ উপজেলা সিলেটের বিশ্বনাথ, ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। বেশি দারিদ্র্য সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা, ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ।
সেমিনারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, এসডিজি অর্জনে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য রয়েছে এর একটি দারিদ্র্য দূর করা, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ করা। দুটি লক্ষ্যের দিকে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক পোভার্টি ম্যাপিং এবং নিউট্রিশন ম্যাপিং করতে হবে, যাতে কোন এলাকায় কী অবস্থা তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, সরকারের সেবাদান পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে; অর্থাৎ কুড়িগ্রামের যে ৭১ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, তাদের সাহায্য দিতে হবে। আবার নারায়ণগঞ্জের ৩ শতাংশ মানুষ, এখানেও দরিদ্র ৩ শতাংশকে সাহায্য দিতে হবে।
প্রকাশিত জরিপের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। সেই সঙ্গে ভোগের ধরনেও পরিবর্তন ঘটেছে। খানার আকার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় খাদ্য ব্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে, সেই সঙ্গে আগের তুলনায় বৈষম্যও বেড়েছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত