নতুন জটিলতায় রেল
অপারেটর বদলের কারণে গত মাসে টানা পাঁচদিন বন্ধ ছিল কম্পিউটার ও অনলাইন টিকিট বিক্রি। কাউন্টার থেকে হাতে লেখা টিকিট কিনতে গিয়ে সে সময় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার পরিচালন জটিলতায় পড়ল রেল। ট্রেনচালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকিট চেকারদের (রানিং স্টাফ) অঘোষিত ধর্মঘটে টানা ৮ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকল গতকাল।
পরে রেলমন্ত্রীর আশ্বাসে দুপুরের পর থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তবে এর আগেই সারা দেশে বাতিল হয়ে যায় ২২টি আন্তঃনগর এবং ১০৩টি মেইল ও লোকাল ট্রেনের যাত্রা। ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে বাকি ট্রেনগুলো। শতাধিক ট্রেনের যাত্রা বাতিল ও বাকিগুলোর শিডিউল বিপর্যয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
জটিলতার শুরু রানিং স্টাফদের অবসরোত্তর কিছু সুবিধা বাতিল করা নিয়ে। ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত রানিং স্টাফরা নির্ধারিত ডিউটির পাশাপাশি কর্মরত অবস্থায় যত দূরত্ব পর্যন্ত কাজ করেছেন তার ভিত্তিতে মাইলেজ হিসেবে বাড়তি ভাতা পেতেন। ১০০ মাইল বা ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রেন পরিচালনার জন্য একদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ রানিং ভাতা বা মাইলেজ প্রাপ্য হতেন।
একইভাবে রেলওয়ে অ্যাক্ট অনুযায়ী রানিং স্টাফদের অবসরোত্তর গ্র্যাচুইটিতে তাদের মূল বেতনের ৭৫ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা পেতেন। গত বছর অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে রানিং স্টাফদের সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মাইলেজ নির্দিষ্ট করে দেয়ার পাশাপাশি বাতিল করে দেয় অবসরোত্তর অতিরিক্ত সুবিধা।
অবসরোত্তর সুবিধা বাতিলের পর থেকেই তা বহালের দাবি জানিয়ে আসছিলেন রানিং স্টাফরা। গত জানুয়ারিতেও একবার তারা কর্মবিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। পরে রেলমন্ত্রী অবসরোত্তর সুবিধা বহালের আশ্বাস দিলে সে সময় কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন রানিং স্টাফরা।
এর মধ্যে গত ১০ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়ে দেয়, ‘বেসামরিক কর্মচারীদের পেনশন ও আনুতোষিক হিসাবের ক্ষেত্রে মূল বেতনের সঙ্গে কোনো ভাতা যোগ করার সুযোগ নেই।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ প্রজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ভোর ৩টা ২০ মিনিট থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। সারা দেশে একযোগে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। ধর্মঘটের কারণে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত রেলওয়ের প্রায় ৩৫০ ট্রেনের মধ্যে ১২৫টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল হয়ে যায়।
গতকাল সকালে বিষয়টি সমাধানে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রেলমন্ত্রী কমলাপুরে সাংবাদিকদের বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হবে। বাতিলে সবরকম চেষ্টা করা হবে। ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হবে। সেখানে রানিং স্টাফদের দাবি নিয়ে আলোচনা হবে। এ সময় আন্দোলনে অংশ নেয়া রেলের রানিং স্টাফদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য নির্দেশনাও দেন মন্ত্রী।
এর কিছুক্ষণ পরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে আগের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করা হয়। বেলা ১টা ৩৯ মিনিটে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুনরায় শুরু হয় ট্রেন চলাচল।
যাত্রা বাতিল হওয়া ট্রেনগুলোর আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়া টিকিটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দিয়েছে রেলওয়ে। তবে টিকিটের টাকা ফেরত পেতেও যাত্রীদের দুর্ভোগ আর নানা ধরনের হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পরে বেলা আড়াইটার দিকে রেল ভবনে ঈদের প্রস্তুতি উপলক্ষে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে রানিং স্টাফদের ধর্মঘট নিয়ে কথা বলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, রেলের রানিং স্টাফরা দীর্ঘদিন ধরেই অবসরোত্তর মাইলেজ সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু গত বছর অর্থ মন্ত্রণালয় তা বন্ধ করে দেয়। এখানে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শুরু থেকেই আমরা রানিং স্টাফদের অবসরোত্তর সুবিধা বহালের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে আসছি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে এ সুবিধা বহালের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্যাটি মিটে যাবে।
এদিকে অঘোষিত ট্রেন ধর্মঘটের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েন বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীরা। রেলওয়ের ট্রাফিক শাখার তথ্য বলছে, বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। ধর্মঘটের কারণে ১২৫টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি আন্তঃনগর ট্রেন।
আন্তঃনগর ট্রেনের সিংহভাগ টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে যায়। ফলে টিকিট কেটে রাখা যাত্রীরা ট্রেন ধরতে এসে পড়েন চরম বিপদে। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনে অপেক্ষা করেন, পরে বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যান। এ সময় বাতিল হওয়া ট্রেনের টিকিটের টাকা ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলে সেই টাকা সংগ্রহ করতে গিয়েও হয়রানির মুখে পড়েন অনেক যাত্রী।
অঘোষিত ধর্মঘটের কারণে প্রায় ১০ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় সামগ্রিকভাবে রেলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ধর্মঘট যে কারণে হোক, তা যাত্রী ও সাধারণ মানুষের কাছে খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকল।
এর আগে ট্রেনের টিকিট ব্যবস্থাপনার অপারেটর পরিবর্তনের কারণে ২১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অনলাইন ও কম্পিউটার টিকিট বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। হাতে লেখা টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে চরম হয়রানির মধ্যে পড়েন যাত্রীরা। ২৬ মার্চ কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রি স্বাভাবিক হলেও এখনো অনলাইনে টিকিট পেতে ভোগান্তি হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত