পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতুতে পাল্টে যাবে দেশ

| আপডেট :  ০৯ মে ২০২২, ০২:২১  | প্রকাশিত :  ০৯ মে ২০২২, ০২:২১

উদ্ভাবন চিন্তা যেখান থেকেই আসুক তা যদি হয় সম্ভাবনাময় তা হলে তা জনস্বার্থে সরকারও গ্রহণ করতে পারে। এখন উদ্ভাবনার যুগ। ঠিক সেখান থেকেই দেশের জন্য ভেবে এমন একটি চিন্তা-উদ্দীপক প্রস্তাব সামনে এনেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান। কেবল ভাবনাতেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি।

পেশাগত কাজের বাইরে তিনি এ নিয়ে অনেকদিন ধরে লেগে আছেন তা বোঝা যায় তার সেই প্রস্তাবিত পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতু ও করিড়োর মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়টি জেনে।

২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রথম তার সে ভাবনা প্রকাশ পায়। এরপর থেকে তিনি নানা দিক খোঁজ-খবর নিয়ে প্রকাশ করেছেন এমন একটি চিন্তা-উদ্দীপক ভাবনার কথা।

এ ব্যাপারে তিনি জানান, আরিচার ১০ কিলোমিটার ভাটিতে পাটুরিয়া-দৌলতিয়ায় আরেকটি একমুখী সেতু তৈরি না করে বরং আরিচায় পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতু এবং করিডোর নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য হতে পারে মাইলফলক। পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে যেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ় প্রত্যয় ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন সেই প্রেরণা থেকেই জনসংযোগ কর্মকর্তা হয়েও তিনি এমন ভাবনা ভাবতে ও এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করতে সাহস পেয়েছেন।

আসুন এখন দেখা যাক তার সেই প্রস্তাবিত পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতু ও করিডোর নির্মাণ স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এ ব্যাপারে তার চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রস্তাব কী-

তিনি বলতে চান যে, আরিচায় পদ্মা ও যমুনার মিলিত স্থানে ইংরেজি ওয়াই (Y) অক্ষরের মতো পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী স্টিল কম্পোজিট সেতু নির্মাণ প্রয়োজন। পদ্মা সেতুর মাওয়া থেকে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর তীরবর্তী দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার।

এর মধ্যবর্তী আরিচা থেকে উভয় সেতু থেকে কমবেশি ৫০-৫৫ কিলোমিটার দূরত্ব রয়েছে। এখানে মিলিত হয়েছে পদ্মা ও যমুনা নদী। এ স্থলে একটি ত্রিমুখী সেতু নির্মাণ করতে পারলে তা দেশের তিনটি ভূ-খণ্ডকে একত্রিত করে দেশের যোগাযোগ ইতিহাসে নতুন অধ্যায় তৈরি করতে পারে। যেহেতু পদ্মা এবং বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল যোগাযোগ সুযোগ আছে তাই আরিচায় প্রস্তাবিত পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতুটি কেবল বাস-ট্রাক, প্রাইভেটকারসহ হালকা যানবাহন ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সম্পন্ন চলাচল উপযোগী করে স্টিল কম্পোজিট সেতু নির্মাণে ব্যয় অনেক কম হবে।

এটা অনেকটা সাসপেনশন টাইপের করা যেতে পারে। এ সেতুর নির্মাণে এমন একটি কল্পিতচিত্র সামনে নেওয়া যায়-তা হলো আরিচা থেকে পদ্মা-যমুনার মিলিত প্রশস্ত অংশের সোজা তিনবা চার কিলোমিটার ভেতরে যেয়ে সেখান থেকে বায়ে চার কিলোমিটার রাজবাড়ীর অংশে এবং একইভাবে মধ্যভাগ থেকে ৫-৬কিলোমিটার ডানে ঈশ্বরদীর রাখালগাছি চরের অংশে যেয়ে শেষ হবে। তা হলে সেতুটি হবে ওয়াই প্রকৃতির।

মাঝখানে ত্রিভুজ আকৃতির অংশ দিয়ে যেকোনো দিকে যানবাহনের গতি পরিবর্তন করা যাবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ শেষ করতে যেয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা এখন আরিচায় একটি ত্রিমুখী সেতু নির্মাণে অনেক সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে এখানে একটি অনুকূল দিক হলো পদ্মা-যমুনার মিলিত স্থলে অনেক আগে থেকেই বালি ভরাট হয়ে অনেকটা জায়গা স্থিত হয়ে আছে।

পদ্মা সেতুর মতো এখানে পাইলিংয়ে এতোটা গভীরতা যেমন প্রয়োজন হবে না তেমনি তা অতোটা জটিল হবে না এমনটি ধারণা করছেন পর্যক্ষেক মহলের অনেকেই। যাইহোক এ ক্ষেত্রে প্রথমে আসে অর্থসংস্থানের প্রশ্ন। ধরে নেওয়া যায় জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা কোনো বিদেশি বিনিয়োগ না পাওয়া গেলে অথবা আংশিক পাওয়া গেলে তাসহ এর অর্থ আসতে পারে উন্মুক্ত শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। এ প্রকল্পের কাজ চূড়ান্ত করে সম্ভাব্য শেয়ার ছেড়ে বাজার থেকে বিনিয়োগ উত্তোলন করা যায়। দেশে এখন দশ, বিশ লাখ টাকা বিনিয়োগের মতো হাজার হাজার সমার্থ্যবান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত মনোবল ও দৃঢ় প্রত্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটিই এখন বাঙালি জাতির যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণের বড় প্রেরণার উৎস। পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতু নির্মাণ করতে যেয়ে কমপক্ষে এক লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান ছাড়াও অন্যান্য কর্মযজ্ঞ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে। দেশের ইস্পাত, লৌহ, সিমেন্ট কারখানা এবং পাথরসহ অন্যান্য আনুসাঙ্গিক সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো মালামাল উৎপাদন ও সরবরাহে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। এ সেতু দিয়ে দিনে রাতে কমপক্ষে ৮-১০ হাজার যানবাহন পারপার হতে পারবে।

আশা করা যায় জাইকা এধরনের প্রকল্পে সহায়তা দিতে পারে এ কারণে যে, এখানে কেবল হালকা যানবাহন চলবে। প্রস্তাবিত পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতুর মধ্যবর্তী যে ত্রিভুজ আকৃতির বাঁক পরিবর্তনের জায়গা থাকবে তার মধ্যবর্তী স্থানে একটি পাঁচতারা হোটেল-মোটেল করা যেতে পারে। যা নদীর ওপর নির্মিত হবে যেখানে গতিপ্রবাহের কোনো ব্যঘাত সৃষ্টি করবে না। এটি বর্ষকালে পানি প্রবাহের সর্বোচ্চ সীমার ৫-১০ মিটার ওপর নির্মিত হবে স্টিলফিকচার টাইপ। ৬-১০ তলা বিশিষ্ট এমন একটি হোটেল নির্মাণ করা গেলে তা হতে পারে দেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় এবং বিশ্বের অন্যতম ভাসমান হোটেল।

এরপরে আসে পদ্মা-যমুনা করিডোর উন্নয়ন প্রকল্প। এমন একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়। পদ্মা সেতুর পূর্ব তীর মাওয়া থেকে পদ্মা নদীর পূর্বতীর হয়ে আরিচা এবং একইভাবে আরিচা থেকে যমুনা নদীর দক্ষিণতীর হয়ে যমুনা সেতু পর্যন্ত মোট কমবেশি ১১০ কিলোমিটার তীরবর্তী যোগাযোগ অবকাঠামো তথা মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ। এটা দুটি ভাগে ভাগ করে করা সম্ভব। একটি মাওয়া থেকে আরিচা ৪৫-৫০ কিলোমিটার এবং আরিচা থেকে যমুনা ব্রিজ ৫৫-৬০ কিলোমিটার। এই মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে দেশের ইতিহাসে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

অপরদিকে এই দুটি বড় নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, আবাসিক প্রকল্পসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমানো সম্ভব। ঢাকার কাছাকাছি শিল্প-কলকারখানা স্থাপন বন্ধ করে পরিবেশ ঝুঁকি কমানো যাবে। পদ্মা ও যমুনার তীর দিয়ে এই করিডোর মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এর আর্থ-সামাজিক ও ভৌগলিক গুরুত্ব বিবেচনায় আশা করা যায় এ প্রকল্পে বিদেশি সহায়তা পাওয়া যাবে।

বিশেষ করে জাইকা বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। প্রয়োজনে এটিও নিজস্ব অর্থে নির্মাণ সম্ভব। এই একশ দশ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে সর্বোচ্চ দশ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে যা সরকারের পক্ষেই যোগান দেওয়া সম্ভব এবং এ মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিদেশের মতো টোল আদায় করা হলে তা বিনিয়োগ রিটার্ন আসবে ২০-২৫ বছরের মধ্যেই।

প্রস্তাবিত পদ্মা-যমুনা ত্রিমুখী সেতু ও পদ্মা-যমুনা করিডোর মহাসড়ক নির্মিত হলে দেশের তিনটি ভূ-খণ্ডকে তা নিবিড়ভাবে যুক্ত করে সারাদেশ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। একইসঙ্গে তা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে ৩-৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হতে পারে। সূত্র: বাংলানিউজ

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত