পে-স্কেল নিয়ে যা শোনা যাচ্ছে
নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। সরকারি জনবলেরও অবস্থা তাই। বিশেষ করে, সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। সরকারি খাতের শ্রমিকদের অবস্থা সর্বাধিক নাজুক হয়ে পড়েছে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তবুও, জনমনে ধারণা, লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বাজারেও ভালো আছে সরকারি কর্মচারীরা।
তবে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে কর্মকর্তা এবং দুর্নীতিবাজরা ভালো থাকলেও নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের অবস্থা ভালো নেই। তাদের অবস্থা সাধারণ মানুষের মতোই অত্যন্ত নাজুক।
১৫ লাখ সরকারি জনবলের কর্মচারিই অধিকাংশ। জনপ্রশাসনের ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস-২০২০’ বইয়ের তথ্য মতে, জনপ্রশাসনের মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩টি পদে লোকবল রয়েছে। ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য রয়েছে। ২০১৫ সালের জাতীয় পে-স্কেলে সরকারি জনবলের বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে কথাটি সঠিক। কিন্তু এতে বিশাল ফাঁক-ফোকর রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না।
যেমন: নিম্ন পদের বেতন দ্বিগুণ হয়ে মাসে বেড়েছে ভাতাদিসহ ৫-৬ হাজার টাকা। আর কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ হয়ে মাসে বেড়েছে ভাতাদিসহ প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, উক্ত পে-স্কেলের গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ পদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা থেকে। আর গ্রেড-২০ বা সর্বনিম্ন পদের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা হয়েছে ৪ হাজার ১০০ টাকা থেকে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ পদের মূল বেতন বেড়েছে ৩৮ হাজার টাকা আর সর্বনিম্ন পদের মূল বেতন বেড়েছে ৪ হাজার ১৫০ টাকা। অর্থাৎ কর্মকর্তার বেতন বেড়েছে কর্মচারীর বেতনের দশগুণ বেশি। প্রশ্ন ওঠে, জিনিসপত্রের মূল্য কি সে হিসাবে নেয়া হয়? না, তা হয় না।
জিনিসপত্রের মূল্য কর্মকর্তার জন্য যা, কর্মচারীর জন্যও তাই। বিন্দুমাত্র তারতম্য হয় না। উপরন্তু জাতীয় পে-স্কেল, ২০১৫-তে টাইম স্কেল সিস্টেম বাতিল করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল কর্মচারীদের জন্য। সরকারি জনবলের মধ্যে কর্মকর্তারা পদোন্নতি, একাধিক গাড়ি ও সার্ভেন্ট, যেনতেন কাজে ঘনঘন দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ ও সফরসহ নানা সুবিধা পায়। কর্মচারীরা এসব সুবিধা পায় না। টাইম স্কেল পেয়ে সে ক্ষতির অনেকটা পুষিয়ে যেত তাদের। পদোন্নতি না পেলেও স্কেল পেয়ে লাভবান হতো। (সর্বোচ্চ তিনটি তথা চাকরির ৮ বছর পূর্তিতে প্রথমটি, ১২ বছর পূর্তিতে দ্বিতীয়টি ও ১৫ বছর পূর্তিতে তৃতীয়টি পেত কর্মচারীরা। উপরন্তু টাইপিস্ট ও স্টেনোগ্রাফাররা স্পিড টেস্টে উত্তীর্ণ হলে ২টি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট পেত। অবশ্য, কর্মকর্তারাও ৪ বছর পূর্তিতে সিলেকশন গ্রেড পেত।) কিন্তু বর্তমান পে-স্কেলে সেসব সুবিধার একটিও নেই। ফলে বেতন দ্বিগুণ হয়ে একদিকে যেমন লাভ হয়েছে, অন্যদিকে, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড ও টেকনিক্যাল ইনক্রিমেন্ট বাতিল হয়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে সবাই।
সরকারি চাকরিজীবীরা আগে অবসরে যাওয়ার পর শতভাগ পেনশন বিক্রি করতে পারতো। কিন্তু দুই তিন বছর হলো পেনশনের অর্ধেকের বেশি বিক্রি করা যায় না। ফলে তারা স্থায়ী কিছু করতে পারছে না। সর্বোপরি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বহু কর্মচারী রয়েছে অস্থায়ীভাবে ও ঠিকা বেতনে। দীর্ঘদিনেও তাদের চাকরি স্থায়ী হয় না। ফলে তারা পে-স্কেল পায়নি, বেতন বৃদ্ধি হয়নি এবং অবসরের কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। কিন্তু মানুষ এসব দেখে না। দেখে শুধু বেতন দ্বিগুণ হয়েছে! তবে এসব ক্ষতির কারণে বর্তমানের দুর্মূল্যের বাজারে সরকারি জনবলের অধিকাংশই চরম কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও পরিবারের লোকদের চিকিৎসার চরম ব্যাঘাত হচ্ছে। অবশ্য, তাদের চাকরি, মাস শেষে বেতন ও অবসরোত্তর পাওনাদির নিশ্চয়তা আছে। এটাই তাদের সান্তনা।
যা হোক, দেশে অতীতে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর জাতীয় পে-স্কেল ও মজুরী কমিশন দেওয়ার রীতি রয়েছে। বর্তমান পে-স্কেল ও মজুরী কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে আগেই। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় নতুন জাতীয় পে-স্কেল ও নতুন মজুরী কমিশন প্রদান করা দরকার। ইতোমধ্যে সে দাবিও উঠেছে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে। তারা সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলও পুনঃচালু এবং পে-স্কেলের ২০টি ধাপের স্থলে ১০টি ধাপ করার দাবি জানিয়েছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত