প্রতিটি টয়লেট তৈরিতে ১ কোটি ২১ লাখ টাকা চায় ডিএসসিসি
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন রূপে সাজবে শিশুদের এ বিনোদনকেন্দ্র। বসবে নতুন রাইড, থাকবে ডিজিটাল টিকেটিংসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। তবে গৃহীত প্রকল্পে বেশকিছু অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পে প্রতিটি টিউবওয়েল (গভীর নলকূপ) স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই কোটি টাকা।
এছাড়াও ছয়টি টয়লেট স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে আরও কিছু খাতে ব্যয় নিয়ে। তবে প্রস্তাবনাকারী সংস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। ফলে অনেক খাতে ব্যয় পুনর্নির্ধারণ করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে সামনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করবে পরিকল্পনা কমিশন। এ লক্ষ্যে পিইসি সভার কার্যপত্র তৈরি করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের (সচিব) সদস্য মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, এখন প্রস্তাবিত প্রকল্পের কার্যপত্র বা আমাদের মূল্যায়ন বের করবো। মূল্যায়ন সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হবে। যাতে পিইসি সভায় উত্তর দেওয়ার জন্য তারা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেন। আগে থেকে বিষয়টি জানা না থাকলে সভায় অনেকেই উত্তর দিতে পারেন না।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক আধুনিকীকরণ প্রকল্পে গভীর নলকূপ ও টয়লেট নির্মাণে বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। আমরা অন্য প্রকল্পের সঙ্গে মিল রেখে তুলনা করবো, এর পরই সিদ্ধান্ত দেবো। প্রতিটি খাত ধরে ধরে বিশ্লেষণ করবো। এমনকি ডিজাইনও (প্রকল্পের নকশা) দেখবো। মোট ব্যয়ের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা ঠিক আছে, কিন্তু বিশ্লেষণ করবো।
প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ৬১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদনের পর চার বছরে বাস্তবায়ন হবে। এ প্রকল্পের অন্য খাতের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রকল্পে অটোমেটিক ওয়েভ বেজড টিকেটিং সিস্টেম বাবদ ১০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সভায় আলোচনা করা হবে। এছাড়া চারটি এলইডি স্ক্রিন বাবদ চার কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে মত দিয়েছে কমিশন।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের মূল্যায়নে অভ্যন্তরীণ ফেরতের হার (আইআরআর) ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রাক্কলন সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে। এছাড়া প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা সঠিকভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অংশে চার-পাঁচটি বুলেট পয়েন্টে এর প্রধান প্রধান কার্যক্রমের পরিমাণগত তথ্যসহ সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটি ও বাস্তবায়ন কমিটির কার্যপরিধি পরিপত্র অনুসারে যথাযথভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। একইসঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ হালনাগাদ করা প্রয়োজন। সে অনুসারে ক্রয় পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা সংশোধন করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, শিশুপার্কের রাইডসমূহ অত্যাধুনিক ও সার্বিক দিক দিয়ে গুণগত মানসম্পন্ন হতে হবে। কোনোভাবেই যাতে নিম্নমানের রাইড সংগ্রহ করার সুযোগ না থাকে সেভাবে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) প্রণয়ন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সভায় আলোচনা হতে পারে। এছাড়া রাইডসমূহের ব্যয় ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি কী তা সভায় আলোচনা করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত রাইডসমূহের প্রাক্কলন সংগ্রহ করা হয়েছে তিনটি কোম্পানির কাছ থেকে। তিনটি কোম্পানি আলাদা আলাদা রাইডের প্রাক্কলন দিয়েছে। ফলে এখান থেকে বের করা যাচ্ছে না গড়মূল্য। অর্থাৎ কোম্পানির ধরা মূল্যই প্রাক্কলন বলে হিসাব করা হয়েছে। প্রায় ১৫৭ কোটি টাকার পূর্ত কাজে ভবন নির্মাণসহ ১৭টি কাজ একটি প্যাকেজের আওতায় রাখা হয়েছে। প্রতিটি কাজের বিস্তারিত ব্যয় প্রাক্কলন পিইসি সভায় উপস্থাপন করতে হবে। একইসঙ্গে উল্লেখ করতে হবে ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তিও।
জানা যায়, একটি ভালোমানের পাবলিক টয়লেট স্থাপনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। আর ঢাকা ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান পানির স্তর বিবেচনায় একটি গভীর নলকূপ বসাতে সর্বোচ্চ খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সেখানে এই প্রকল্পে খরচ কয়েকগুণ বেশি দেখানো হয়েছে।
গভীর নলকূপ ও টয়লেট নির্মাণে বাড়তি ব্যয় প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পটি এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। অনেক কিছুর ব্যয় যুক্তিযুক্ত নির্ধারণ করা হবে। কোনো কোনো ব্যয় বাদ যাবে আবার যুক্ত হবে কিছু। তবে এখনো কিছুই চূড়ান্ত পর্যায়ে আসেনি।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য
বিনোদনসেবা বাড়ানোর মাধ্যমে শিশু-কিশোরসহ জনগণের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি, শিশু-কিশোরসহ জনগণের উন্নতমানের বিনোদন সেবার সুযোগ তৈরি করা।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম
১৫টি বিভিন্ন ধরনের রাইড কেনা ও স্থাপন, ডিজিটাল টিকিট সিস্টেম, সেন্ট্রাল সাউন্ড সিস্টেমসহ এলইডি স্ক্রিন স্থাপন, গ্যালারি, এম্ফিথিয়েটার, সীমানাপ্রাচীর, ড্রেন, ভবন নির্মাণ, দর্শনার্থীদের জন্য শেড নির্মাণ, বৃক্ষরোপণসহ সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে।
একইসঙ্গে বিনোদন সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাইড যেমন- মাইন কোস্টার, ক্যারোসল ডাবল ডেক, সুপার সুইং, টি-কাপ, স্পেস শাটল, মিউজিক বোট, জেলিফিশ স্যারাউন্ডিং গার্ডেন ট্রেন, এয়ার বাইসাইকেল, আর্থকোয়েক, ৯টি থিয়েটার অ্যালার্ট, ক্লাম্বিং কার সংগ্রহ করা হবে।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এটা বিভিন্ন খাতে পরিষেবা যেমন- রাস্তা মেরামত ও উন্নয়ন, ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়কবাতি স্থাপন, শহর উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, নগরবাসী ও শিশু-কিশোরদের বিনোদন সেবা দেওয়া এবং বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজ করা। ডিএসসিসির অন্যতম কাজের মধ্যে একটি হলো নগরবাসীর বিনোদন সেবার ব্যবস্থা করা। এরই অংশ হিসেবে শাহবাগ কেন্দ্রীয় শিশুপার্কে নগরবাসীসহ শিশু-কিশোরদের দীর্ঘদিন ধরে বিনোদন সেবা দিয়ে আসছে।
একসময় কেন্দ্রীয় শিশুপার্কে বিনোদন সেবা দিতে ১১টি রাইডস/খেলনা ছিল। এই রাইডস/খেলনা মেরামত করে সেবা দিয়ে আসছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ব্যবহারের অযোগ্য আটটি রাইডস নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। বাকি তিনটি রাইডস মেরামত করে স্থাপন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। শিশুপার্কে স্থাপিত রাইডসমূহ দীর্ঘদিনের পুরোনো ও প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় তা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বিনোদন সেবা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় নগরবাসীর চাহিদা পূরণে যুগোপযোগী আধুনিক রাইডস স্থাপন করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় শিশুপার্কটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এখানে দৈনিক সাত থেকে আট হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটতো। তাছাড়া বিভিন্ন উৎসব যেমন- ঈদ, নববর্ষ, দুর্গাপূজাসহ জাতীয় দিবসগুলোতে ভিড় হতো ৫০-৬০ হাজার দর্শনার্থীর। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরোনো ও সীমিত রাইডস দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বিনোদন সেবা দেওয়া যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় শিশুপার্কে আধুনিক ও যুগোপযোগী রাইডস স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত