প্রীতির এক দিক দিয়ে গুলি ঢুকে বুক ছিড়ে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়
সারাজীবনে কি এই আক্ষেপ ভুলতে পারবেন হোসনে আরা শেফালী? বৃহস্পতিবার রাতে তার মেয়ে সামিয়া আফনান প্রীতি বান্ধবীর বাসা থেকে ফিরছিলেন। তাদের ছোট্ট বাসা তখন বেড়াতে আসা আত্মীয়-স্বজনে পরিপূর্ণ। শেফালী তাই ফোনে মেয়েকে বলেন, ‘তোর মামারা আসছে। বাসায় থাকার সমস্যা। আজ বান্ধবীর বাসাতেই থাক, কাল আসিস’। সেই কাল যে আর কোনোদিনই আসবে না, কে জানত! বাসায় ফেরার পথেই মায়ের ফোন পেয়ে প্রীতি ফিরে যাচ্ছিলেন তার বান্ধবীর বাসায়। এ সময় রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুর রেলগেট এলাকায় দুর্বৃত্তের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ যায় তার। ২২ বছর বয়সী প্রাণচঞ্চল মেয়েটির এমন মৃত্যুর জন্য এখন নিজেকেই দায়ী মনে করছেন তার মা। তার কান্না-বিলাপ থামছে না কিছুতেই।
মৃতের স্বজন-বন্ধুরা বলছেন, এই মৃত্যুর দায় কার? কেন নির্দোষ মেয়েটিকে এভাবে প্রাণ দিতে হল? স্বল্প আয়ের বাবার সংসারে তিনি ছিলেন আশার আলো। তাকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনছিলেন পরিবারের সদস্যরা। পড়ালেখার পাশাপাশি তাই তিনি চাকরির চেষ্টাও করছিলেন। শুক্রবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার কথা ছিল তার। সব ঠিক থাকলে এপ্রিলে কাজে যোগ দিতেন। কিন্তু তার আগেই ঘাতকের বুলেটে নিভে গেল পরিবারটির আশার প্রদীপ।
প্রীতি তার পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর পশ্চিম শান্তিবাগের ২১৮ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় দুই বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় শোকাতুর পরিবেশ। আত্মীয়-স্বজন ভিড় করে আছেন। মেয়েহারা মাকে সান্ত্বনা দিতে আসছেন প্রতিবেশীরাও। এর মধ্যেই ঘরের এক কোণে একটি বিড়াল চোখে পড়ল। সেখানে উপস্থিত প্রীতির এক খালা জানালেন, পোষা প্রাণীর প্রতি বিশেষ দরদ ছিল তার ভাগ্নির। বিড়ালটি তার পোষা। প্রতিদিন নিয়ম করে তার যত্ন নিতেন। আর বিড়ালটিও ছিল তার খুব ন্যাওটা। সারাক্ষণ পায়ে পায়ে ঘুরত। কখনও বাসায় না থাকলে তিনি ভিডিওকলে বিড়ালকে দেখতেন। সেই প্রিয় মানুষটির এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বিড়ালটির মধ্যেও এসেছে অদ্ভুত পরিবর্তন। যেন সে কোনো একটা দুঃসংবাদ আঁচ করতে পেরেছে।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে সে খুব অস্থির হয়ে আছে। কিছু খাচ্ছেও না। ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ পেলেই ছুটে যাচ্ছে। যখন দেখছে প্রীতি নয়, তখন বিমর্ষ হয়ে আবার ঘরের কোণে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে। শুধু বাসার পোষা বিড়ালই নয়, রাস্তার কুকুরগুলোর সঙ্গেও ছিল মেয়েটির সখ্য। রাস্তায় তাকে দেখলেই সারমেয়কুল লেজ নাড়তে নাড়তে এসে হাজির হতো। প্রীতি তখন তাদের বিস্কুট-পাউরুটি খেতে দিতেন। প্রাণীর প্রতি যার এত ভালোবাসা, সেই মেয়েটির প্রাণটিই গেল বেঘোরে।
প্রীতির খালা আরও জানান, বয়সের ব্যবধান থাকলেও ভাগ্নির সঙ্গে তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল। মন খারাপ থাকলে তারা একসঙ্গে বেড়াতেন। শাড়ি পরে রিকশায় ঘুরতেন। কোনো কারণে কষ্ট পেলে তাকেই ফোন দিতেন প্রীতি। তিনি ফ্যাশন সচেতন ছিলেন। ভবিষ্যতে ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সুন্দর ছবি আঁকতে পারতেন।
শোকে বিধ্বস্ত প্রীতির মা হোসনে আরা শেফালী শুক্রবার কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘আমারে মেয়ের লাশটা আইনা দেন। আর কিছু চাই না’।
বৃহস্পতিবার রাতে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় দুর্বৃত্ত। এতে ব্যক্তিগত গাড়িতে থাকা টিপু, তার গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্না এবং অদূরে রিকশায় থাকা প্রীতি গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর টিপু ও প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন মিরপুরের একটি কারখানায় কাজ করেন। শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তার সঙ্গে কথা হয়। সন্তান হারানোর শোকে তিনি যেন পাথর হয়ে বসে ছিলেন। এমনকি তিনি এ ঘটনার বিচারও চান না। তিনি সমকালকে বলেন, ‘কারও কাছে বিচার চাই না, বিচারের মালিক আল্লাহ’। তার ধারণা, হত্যাকারীর টার্গেট তার মেয়ে ছিল না, ঘটনাচক্রে তিনি খুন হন। তাই এই হত্যাকাণ্ডকে তিনি বলছেন ‘দুর্ঘটনা’। তবে এমনভাবে যেন আর কোনো মা-বাবার বুক খালি না হয়, সেই আকুতিও জানান।
তিনি জানান, ছয়-সাত বছর আগে পরিবারকে না জানিয়ে নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেন প্রীতি। তবে সেই সংসার বেশিদিন টেকেনি। গত বছর তিনি বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। ফল ভালো না হওয়ায় আবার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। তার ছোট ভাই শোয়েব জামান সামি এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
জামাল উদ্দিন বলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও সংসারে সুখ ছিল। কষ্টের মধ্যেও এক ধরনের সুখ আছে, সেটা টাকার মধ্যে নাই। কিন্তু সেই সুখটা ধ্বংস হয়ে গেল।
মেয়েকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও জানালেন তিনি। সেজন্য মেয়েকে কম্পিউটার কোর্সে ভর্তিও করে দিয়েছিলেন। দু-তিন মাস পর তাকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল।
প্রীতির বান্ধবী সুমাইয়া আক্তার জানান, তার বাসা খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায়। মা বাসায় না থাকায় বান্ধবীকে কয়েকদিন তার সঙ্গে থাকতে বলেছিলেন। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে কয়েকদিন থাকার পর বৃহস্পতিবার প্রীতি নিজের বাসায় ফিরছিলেন। তবে রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি ফোন করে সুমাইয়াকে খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় যেতে বলেন। সেখান থেকে দুই বান্ধবী রিকশায় উঠে তিলপাপাড়ার উদ্দেশে রওনা হন। হঠাৎ বিকট শব্দে ভয় পেয়ে রিকশা থেকে লাফ দেন তারা। শুরুতে ভেবেছিলেন কোনো যানবাহনের চাকা বিস্ম্ফোরিত হয়েছে। পরে গুলির বিষয়টি বুঝতে পারেন। সেইসঙ্গে লক্ষ্য করেন, প্রীতির গুলি লেগেছে। রিকশা থেকে নিচে পড়ে যাওয়া প্রীতি আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি।
প্রীতিদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। শাহজাহানপুরের স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফনের কথা রয়েছে।
ঢামেক মর্গ সূত্র জানায়, টিপুর শরীর থেকে সাতটি গুলি বের করা হয়েছে। আর প্রীতির শরীরে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। কারণ তার শরীরের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে একটি গুলি বেরিয়ে গেছে।
ময়নাতদন্তের আগে টিপু ও প্রীতির লাশের সুরতহাল তৈরি করা হয়। প্রীতির লাশের সুরতাল করেন শাহজাহানপুর থানার এসআই তমা বিশ্বাস।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত