বহু পরিবার পথে বসেছে, তবুও সমাধান নেই রেল ক্রসিংয়ে
দেশের লেভেল ক্রসিংগুলো পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে। প্রায় প্রতিদিনই কাড়ছে মানুষের প্রাণ। উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে বহু পরিবার বসছে পথে। বহু মানুষকে পঙ্গুত্ববরণ করে পরিবারের বোঝা হয়ে উঠতে হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্রেনের ইঞ্জিন, কোচ ও রেলপথেরও। ইঞ্জিন-কোচ কোনোটি অচলও হয়ে যাচ্ছে। ইঞ্জিন ও কোচ সংকটে থাকা রেল এতে আরও বেশি ধুঁকছে। প্রভাব পড়ছে সেবার মানে।
নীলফামারীর দারোয়ানী লেভেল ক্রসিংয়ে বুধবার ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যায় অটোরিকশার চার যাত্রীর। গুরুতর আহত হন আরও ছয় জন-যাদের কয়েকজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এর দুদিন আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলীনগর রেল লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মারা যান ৩ নসিমন-যাত্রী।
কখনো কখনো এ সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১০-ও। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট ঝিনাইদহে লেভেল ক্রসিংয়ে বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের ১৩ জন, ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জে বর-কনেসহ মাইক্রোবাসযাত্রী ১২ জনের মৃত্যু হয়। এভাবে এক যুগে শুধু লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় অন্তত ২১৫ জনের প্রাণ গেছে। রেলের হিসাবে, ২০২০ সালে ৯, ২০১৯-এ ২০, ২০১৮-তে ২৩, ২০১৭ সালে ১৭, ২০১৬-তে ২২, ২০১৫-তে ১৭ ও ২০১৪ সালে ৩১ জন মারা গেছেন।
এত মানুষের মৃত্যু হলেও তার দায় নেয়নি কোনো সংস্থা। বাংলাদেশ রেলওয়ে বলছে, লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দায় রেলের নয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ (এলজিইডি) লেভেল ক্রসিং নির্মাণকারী সংস্থাগুলোও এড়িয়ে চলছে। এত মানুষের মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে এ সময়ে নামমাত্র কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর কিছুই হয়নি।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে ২ হাজার ৭৮৯টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২১টিই অবৈধ। আবার বৈধ ১ হাজার ৪৬৮টির মধ্যে ৯০৪টিতেই কোনো নিরাপত্তারক্ষী (গেটম্যান) নেই। অর্থাৎ ৬২ শতাংশ বৈধ ক্রসিংয়ে নিরাপত্তারক্ষী নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৯৫০টিই এলজিইডির তৈরি বা তাদের অর্থায়নে ইউনিয়ন পরিষদের নির্মিত। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) ১২টি, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ৫৪টি, উপজেলা পরিষদ ৯টি, পৌরসভা ১১৬টি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি ১৭০টি লেভেল ক্রসিং নির্মাতা।
রেল বলছে, প্রথম ট্রেন চালানোর ১০ বছরের মধ্যে এর ওপর দিয়ে কোনো সড়ক গেলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের। এরপর কোনো সড়ক নির্মাণ হলে তা আগে রেল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সড়কের কারণে তৈরি লেভেল ক্রসিংয়ে পথরোধক ও পাহারাদার দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার। রেলওয়ে আইন ১৮৯০-এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ট্রেনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড হবে। তবে এটি কখনো কার্যকর করতে দেখা যায়নি। আইনে আরও বলা হয়েছে, রেলে কোনো অবৈধ লেভেল ক্রসিং থাকতে পারে না। কোথাও গড়ে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছেদ করতে হবে। নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে অধিকাংশ লেভেল ক্রসিংয়ে নেই নিরাপত্তা বার (লোহা বা বাঁশ)। আবার যেখানে বার রয়েছে সেখানে শেষ মুহূর্তেও সেই বার উঠিয়ে বা এর নিচ দিয়ে চলাচল করছে অনেক যান/ব্যক্তি। আবার লেভেল ক্রসিংগুলো যথাযথ মানের না হওয়ায় রেলপথে আটকে যাচ্ছে যান। সেই সঙ্গে সতর্কতার ঘাটতি ও ঝুঁকি নিয়ে দ্রুত চলাচলের চেষ্টায় লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। কোনো লেভেল ক্রসিংয়েই নেই আলোর ব্যবস্থা।
রেলওয়ে অপারেশন ও ট্রাফিক বিভাগের দুই কর্মকর্তা জানান, রেলওয়ে গত এক দশকে রেললাইন তৈরি, ইঞ্জিন ও কোচ এবং কেনাকাটায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। বর্তমানে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। তা ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সওজ প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে বলতে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম কাউকে নিতে দেখা যায়নি।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধভাবে লেভেল ক্রসিং তৈরি অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় সরকার এবং রাজনৈতিক নেতারা তা তৈরি করছে। ভোটের রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে জনপ্রতিনিধিরা তা তৈরি করেন বা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। রেলওয়ে মহাপরিচালক দপ্তর সূত্র জানায়, অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বহুবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিধের বাধা, হুমকি ও হামলার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
রেল বলছে, রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কে উড়ালপথ নির্মাণ, ট্রেন আসার সময় যানবাহন আটকে দেওয়ার জন্য পথরোধক (ব্যারিকেড) বসানো এবং ট্রেন এলে তা সময়মতো নামিয়ে যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখার জন্য পাহারাদার নিয়োগ নিশ্চিত করা এলজিইডি ও সওজের দায়িত্ব। এজন্য সংশ্লিষ্টদের তিন যুগে বহুবার চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবর মাসে রেলওয়ে, এলজিইডি ও সওজের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সমন্বিত কমিটি গঠন করা হয়। আরেক সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৯তম বৈঠকের সুপারিশ থেকে জানা যায়, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে নিরাপত্তাকর্মী ও ঘুণ্টি ঘর নির্মাণ এবং নিরাপদ ট্রেন চলাচল ও জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি ডিপিপি প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটির সর্বশেষ অবস্থা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন যুগান্তরকে জানান, রেলওয়ে বিভাগীয় ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সমন্বয়ে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে। পরিদর্শনে ঝুঁকিপূর্ণ ক্রসিংগুলোর ভয়াবহতা উঠে আসছে। তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, এর আগেও এমন সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছিল, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এলজিইডির সাবেক এক প্রধান প্রকৌশলী যুগান্তরকে জানান, অবৈধ লেভেল ক্রসিং উচ্ছেদের উদ্যোগ এক যুগ আগেই নেওয়া হয়েছিল। রেল ও এলজিইডি কর্মকর্তারা এ নিয়ে বহুবার বৈঠকও করেছে। একমত হয়েছিল-গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংয়ে ফ্লাইওভার বা আন্ডারপাস করার। লেভেল ক্রসিং রক্ষণাবেক্ষণ ও গেটম্যান দিতে রাজি হয়েছিল এলজিইডি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোর মুখে দেখেনি।
এ বিষয়ে জানতে এলজিইডির (রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা শাখা) কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, যুগের পর যুগ ধরেই রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা হচ্ছে। কোনোটা বৈধ, কোনোটা অবৈধভাবে। এখন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে উভয় সংস্থার সমন্বয়ে সরেজমিন অবৈধ ক্রসিংগুলো পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট দেওয়ার। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা না পেলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। এসব রাস্তা ঘিরে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ভোটের রাজনীতি আছে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে ডিএন-১ আব্দুল হানিফ জানান, আমরা ইতোমধ্যে ১৮টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছি। ক্রসিংয়ের দুপাশে উঁচু ওয়াল ও লোহার বার পুঁতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়রা এসব ভেঙে পুনরায় রাস্তা তৈরি করে ফেলছে। লোহার বার কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. কামরুল আহসান জানান, ট্রেন রেললাইন ছেড়ে সড়কে উঠে কোনো যানবাহনকে আজ পর্যন্ত ধাক্কা দেয়নি। সড়কযান প্রতিনিয়ত লাইনে উঠছে। অথচ এসব দুর্ঘটনায় রেলকে দায়ী করা হচ্ছে। আমরা বহুবার সংশ্লিষ্টদের পত্র দিয়েছি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে, করেনি। আমরা সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, বৈধ কিংবা অবৈধ ক্রসিংগুলোর ওপর সার্ভে করছি। আমরা প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে বিশেষ ডিভাইস লাগাব। দুপাশে হর্নসহ কালার বাতি জ্বলবে-কোনো ট্রেন লেভেল ক্রসিংয়ের এক কিলোমিটার দূরে থাকতেই। এ ক্ষেত্রে ট্রেনের ইঞ্জিনে বিশেষ ডিভাইস লাগানো থাকবে। তিনি বলেন, এসব উদ্যোগ বাস্থবায়নেও খুব বেশি লাভ হবে না। যতক্ষণ না সড়কের যান চালকদের বেপরোয়া মনোভাব না বদলাবে। মানুষ সতর্ক না হবে।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম সামছুল হক বলেন, লেভেল ক্রসিংয়ে মানুষ মরছে-সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। এর দায় কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ কারা করছে, কে করাচ্ছে-তা চিহ্নিত করতে হবে। এ ছাড়া বৈধ ক্রসিংগুলোতে সুরক্ষার দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। ১৩২১টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং কী করে হলো-এর দায় রেল এড়াতে পারে না। লেভেল ক্রসিং ও রক্ষণাবেক্ষণ ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতিও রয়েছে।
রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন জানান, বর্তমানে কোথাও অবৈধ লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে রেলের। ট্রেনের যাত্রী-চালকরাও মারা যাচ্ছে। ইঞ্জিনসহ কোচ নষ্ট হচ্ছে-নষ্ট হচ্ছে রেললাইনও। অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করতে এবং নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। যুগান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত