বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেই যাচ্ছে, দেশে খবর নাই
গত মে মাসেও আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৯৬৩ ডলার। ধারাবাহিকভাবে দাম কমতে কমতে গত সোমবার তা নেমে আসে ১ হাজার ৪৪৮ ডলারে। সে হিসেবে পণ্যটির দাম কমেছে টনে ৫১৫ ডলার। একই সময়ে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম কমেছে টনে ৬৫১ ডলার। মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত পাম অয়েলের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৭১৭ ডলার। সোমবারের বাজারে তা লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬৬ ডলারে। সে হিসেবে গত দুই মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম কমেছে যথাক্রমে ২৬ দশমিক ২৩ ও প্রায় ৩৮ শতাংশ।
দেশের বাজারে এ দুই ধরনের ভোজ্যতেলের দামে আন্তর্জাতিক বাজারের কোনো প্রভাবই দেখা যাচ্ছে না। গত ২৬ জুন সরকারের পক্ষ থেকে লিটারপ্রতি সয়াবিনের দাম ৬ টাকা কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। যদিও এর আগে ৯ জুন সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। আবার গত ৯ জুন পাম অয়েলের দাম ১৪ টাকা কমানোর পর পণ্যটির দামে আর কোনো সংশোধন আনা হয়নি। সাধারণ ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের অভিযোগ, মূল্যস্ফীতির বাজারে কোরবানির ঈদ এগিয়ে এলেও এ মুহূর্তে দাম কমানোর কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আমদানিকারক কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দিতে গিয়েই সংশ্লিষ্টরা এখন ভোজ্যতেলের মূল্যহ্রাসে দীর্ঘসূত্রতা দেখাচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ-সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামের উত্থান-পতন পর্যালোচনা করে ২৬ জুন দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মুহূর্তে আপাতত সরকারিভাবে দাম কমানোর কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববাজারের দামের তারতম্য পর্যালোচনা করে ঈদের পর আবারো দাম সমন্বয় করা যেতে পারে।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও ডলারের বিনিময় হার, জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম আগের পর্যায়ে ফিরলেও দেশে এর সম্ভাবনা কম। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান দরে কেনা পণ্যগুলো দেশের বাজারে এলে সব সংস্থার বৈঠকে পর্যালোচনা করে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে।
জানতে চাইলে ট্যারিফ কমিশনের জাতীয় মূল্য পর্যবেক্ষণ ও নির্ধারণ কমিটির সদস্য মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে, সেখানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নেতারা থাকেন। এরই মধ্যে জুনের শেষ দিকে ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় দেশের বাজারেও একই পদ্ধতির অনুসরণে দামের সমন্বয় হবে। তবে বর্তমান সময়ে ডলারের বিনিময় হার, শিপিং চার্জ ও জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও প্রভাব ফেলছে।
যদিও ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দাম না কমালেও বিশ্ববাজারে দরপতনের প্রভাব এরই মধ্যে পাইকারি বাজারগুলোয় পড়তে শুরু করেছে। এক মাস আগেও ভোজ্যতেলের বাজারে কেনাবেচা রমরমা ছিল। বর্তমানে আগের কেনা এসওগুলো (সরবরাহ আদেশ) যেকোনোভাবে বিক্রি করতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা। এতে পাইকারি বাজারে মণপ্রতি পাম অয়েল ও সয়াবিনের দাম কমেছে অন্তত ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু সরকারিভাবে দাম নির্ধারণের কারণে খুচরা বাজারে সাধারণ ভোক্তারা এর কোনো সুফল পাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় একেক কোম্পানি খোলা পর্যায়ে একেক দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করলেও সরকারিভাবে পুনর্নির্ধারণ না হওয়ায় ভোজ্যতেলের বাজারে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কিছুদিন আগেও ভোজ্যতেল ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে আকর্ষণীয় একটি পণ্য। বিশ্ববাজারে টানা দরপতনে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছেন ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা। এখন ব্যবসায়ীরা যেকোনোভাবে হাতে থাকা ভোজ্যতেল বিক্রি করতে পারলেই বাঁচেন। কিন্তু দাম কমতে থাকায় চাইলেও মজুদ পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। সরকার পতনমুখী বাজারকে ব্যবসায়ী বা ভোক্তাবান্ধব উপায়ে স্থিতিশীল রাখতে পারছে না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কিংবা কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হলে এক যুগ আগের মতোই ভোজ্যতেল বাণিজ্যে ধস অনিবার্য।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে জুনের শেষ সপ্তাহে ভোজ্যতেলের দাম ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। খাতুনগঞ্জে এখন প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) পাম অয়েল ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৫ হাজার ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৬১০ থেকে ৬ হাজার ৬৮০ টাকায়। গত দুই সপ্তাহে পাম অয়েলের দাম কমেছে মণে ১ হাজার ৭০০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম কমেছে মণে প্রায় ৯০০ টাকা। যদিও খুচরা বাজারে এর কোনো প্রতিফলনই নেই।
এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর যুক্তি হচ্ছে ভোজ্যতেলের আমদানি, পরিশোধন ও বিপণন কার্যক্রম সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বিশ্ববাজারের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে এর মূল্য সমন্বয় করা হয় না। বরং এক মাস বা তারও বেশি সময় আগে আমদানি করা পণ্যের দামের সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে তা সমন্বয় করা হয়। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাসের এলসি (ঋণপত্র) গড় মূল্য, ইনবন্ড গড় মূল্য, এক্স-বন্ড গড় মূল্যকে নিয়ে একটি সার্বিক গড় তৈরি করা হয়। এরপর আমদানি খরচ, পরিবহন, পরিশোধন, বিপণন পর্যায়ের খরচ যুক্ত করে নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খরচ যুক্ত না করায় দাম আপাতত না বাড়লেও কমানোর সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশন-সংশ্লিষ্টরা।
তবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এসব তথ্যকে অযৌক্তিক বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এক মাস পর সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের ফলে বাজারে এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। মিলগেট থেকে পণ্য যে দামে বিক্রি করা হয়, বিশ্ববাজারে বুকিং দর ওঠানামার সঙ্গে তা সমন্বয় করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের লোকসানে পণ্যটি বিক্রি করতে হয়। মে ও জুনের শুরুতে যেসব পণ্য বিশ্ববাজার থেকে কেনা হয়েছে সেগুলো এরই মধ্যে দেশের বাজারে এসে পৌঁছেছে। এ সময়ে বিশ্ববাজারের দাম পর্যালোচনা করলে দেশের বাজারে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম আরো কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু সরকার জুনের শুরুতে শুধু পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৭ টাকা বাড়িয়ে দেয়। এরপর নানামুখী চাপে জুনের শেষার্ধে সয়াবিনের লিটারপ্রতি দাম মাত্র ৬ টাকা কমালেও পাম অয়েলের দামে কোনো পরিবর্তন করেনি, যার কারণে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের মুনাফা স্বাভাবিক থাকলেও ট্রেডিং ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা ভোজ্যতেল কেনাবেচা করতে গিয়ে ঠকছে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, মে মাসে আমদানি হওয়া ভোজ্যতেলের দামের সঙ্গে দেশীয় বাজারজাত ভোজ্যতেলের দামে পার্থক্য রয়েছে। মে মাসে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৭৮ হাজার ৫৫৭ টন, যার ৫ শতাংশ শুল্কসহ মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১১৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে শুল্কসহ অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি খরচ দাঁড়ায় টনপ্রতি ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৮৩ টাকা। যদিও পণ্যটির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে লিটারপ্রতি ১৯৯ টাকা। অন্যদিকে মে মাসে দুটি বন্দর দিয়ে ৫৭ হাজার ৫৫৭ টন পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ৯৪৭ কোটি ২৯ লাখ টাকায় (শুল্কসহ)। শুল্কসহ টনপ্রতি অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৪২ হাজার ১৪৫ টাকা। বর্তমানে সরকারিভাবে লিটারপ্রতি মূল্য নির্ধারিত রয়েছে ১৫৮ টাকা।
জানা গেছে, রমজানের ঈদের আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো না হলেও ঈদের পরপর গত ৫ মে দেশের ইতিহাসে ভোজ্যতেলের লিটারপ্রতি দাম (সয়াবিন তেল) এক ধাক্কায় রেকর্ড ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়। বড় আকারের এ দরবৃদ্ধি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালীন অতিমারীতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান দুই ভোজ্যতেল পাম অয়েল ও সয়াবিন উৎপাদন নিয়ে সংকটে ছিল উৎপাদনকারী দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়া, দুনিয়াব্যাপী লকডাউনে পরিযায়ী ও বিদেশী শ্রমিক সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমায় মজুদ রাখতে বেগ পেতে হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলোকে। এতে করোনাকালে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিম্নমুখী ও স্থিতিশীল ছিল। মূল সমস্যা শুরু হয় লকডাউন থেকে একের পর এক দেশ বেরিয়ে আসার পর। হঠাৎ চাহিদা বাড়লে চাহিদার তুলনায় মজুদ ও উৎপাদন কম থাকায় অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর। একপর্যায়ে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ পাম অয়েল উৎপাদক দেশ ইন্দোনেশিয়া রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর বিশ্ববাজারে মে মাসে স্মরণকালের রেকর্ড দরে পৌঁছে পাম অয়েল ও সয়াবিনের দাম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়তি মুনাফার আশায় উৎপাদনকারী দেশগুলো উৎপাদন বাড়াতে থাকলে ফের কমতে শুরু করে ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক দর। আগামীতে তা আরো কমার পূর্বাভাস রয়েছে।
বণিক বার্তা
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত