বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরপরই ফের বেপরোয়া ছাত্রলীগ
করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধের পর ক্যাম্পাস খুলেছে প্রায় দুই মাস। কিন্তু এরই মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আসছে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। কোথাও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে আবারও অনিশ্চয়তায় পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া ক্লাস চলছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর চালানো হচ্ছে অত্যাচার-নির্যাতন। প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনাও আছে। গত কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত তথ্য উঠে এসেছে। একইভাবে গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে বেরিয়ে এসেছে অনেক তথ্য।
এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী কয়েকশবার সংঘর্ষ, মারামারি, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, শিক্ষার্থী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। আছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগও।
সংগঠনটি সর্বশেষ আলোচনায় এসেছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) এক শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনার পর। সেলিম হোসেন নামে ওই অধ্যাপককে ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী মানসিক নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে আরেক আলোচিত ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক)। সেখানে হকিস্টিক দিয়ে মাহাদী জে আকিব নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীর মাথা থ্যাঁতলে দেয় একই দলের প্রতিপক্ষের কর্মীরা। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে এই কর্মী।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে রাতে কয়েক ঘণ্টা ধরে দুই ছাত্রীর ওপর মানসিক নির্যাতন চালানোর (নাচতে বাধ্য করা) অভিযোগ আসে কয়েক নেত্রীর বিরুদ্ধে। রোববার অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দুই গ্রুপে মারামারির ঘটনা ঘটে।
একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের কারণে হলের কয়েকটি কক্ষ ও মসজিদ ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-চমেক ও কুয়েট।
মহামারি পরিস্থিতিতে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১৩ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু সংঘর্ষের কারণে গত আড়াই মাসের মধ্যে এক মাসই বন্ধ ছিল চমেক। ২৭ নভেম্বর ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হয়েছে। ৩ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর সর্বশেষ রোববার ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের আবাসিক হলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৪ নভেম্বর রাজধানীতে নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ইউরোপ সফরে যান। ওইদিন ফেরা উপলক্ষ্যে তার অনুসারীরা রাস্তা দখলে নিয়ে ইব্রাহিমকে স্বাগত জানান। এ কারণে সেদিন এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়ে। কেউ কেউ সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি। এ ঘটনায় অবশ্য তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ছাত্রলীগ ৫০ লাখ নেতাকর্মীর বিশাল এক সংগঠন। এখানে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি, তা বলার সুযোগ নেই। তবে যখনই এমন কোনো খবর এসেছেম আমরা অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে গিয়েছি। সাধারণ শিক্ষার্থী বা নাগরিকদের কোনো হয়রানির ঘটনা বরদাশত করিনি। বিভিন্ন ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে স্থায়ী বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো-কখনো কোথাও কিছু হলেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘটিত বিশৃঙ্খলার দায়ও ছাত্রলীগের ওপর চাপানো হচ্ছে। ইউনিটগুলোয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করে এমন বেশকিছু বিষয় আমরা পেয়েছি, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত।
তিনি আরও বলেন, কুয়েটের বিষয়ে অভিযোগ করা হচ্ছে। অথচ সেখানের সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। এতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কক্ষ থেকে বের হয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে বাসায় গেলে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়। এখন সেই অসুস্থতার দায়ও ছাত্রলীগকে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এমন অসুস্থতায় তো যে কেউ মারা যেতে পারেন। আমাদের বক্তব্য হলো-ছাত্রলীগে বিশৃঙ্খলা করে কেউ পার পায়নি এবং পাবেও না। এ বিষয়ে আমাদের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাত্রলীগকে যেন ভিকটিম না করা হয়।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গত ৫ বছরে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটিয়েছিল বুয়েটে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে আবরার ফাহাদ নামে এক ছাত্রের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এরপর তার লাশ উদ্ধার হয়। ওই ঘটনায় মামলা হয় ঢাকার নিম্ন আদালতে। অভিযুক্ত সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ৮ ডিসেম্বর এই মামলার রায়ের তারিখ নির্ধারিত আছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বাক্য-‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। চমেক ছাত্রলীগ নেতা আকিব প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন। আঘাতে তার মাথার পরিস্থিতি এমন ছিল যে, খুলি কেটে তা পেটের চামড়ার নিচে সংরক্ষণ করে এরপর খালি মাথা ব্যান্ডেজ করে রাখতে হয়েছিল। চিকিৎসকরা ওই ব্যান্ডেজের ওপর লিখে রেখেছিলেন বাক্যটি।
স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ১৩ সেপ্টেম্বর খোলার পর থেকে কলেজটিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছিল। এর রেশ ধরে প্রথমে ২৯ অক্টোবর সংঘর্ষ হয়। পরে ৩০ অক্টোবর কলেজের গেটে পেয়ে প্রতিপক্ষ তাকে পেটায়। ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ৩০ জনকে কলেজ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। এছাড়া কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলেও পরে ২৭ নভেম্বর খুলে দেওয়া হয়। কলেজটিতে দুই গ্রুপে প্রায়ই সংঘর্ষ ও মারামারি ঘটে বলে জানা গেছে।
এদিকে ছাত্রলীগকে ঘিরে চলমান আলোচিত ঘটনাটি কুয়েটে ঘটেছে। ছাত্রলীগ নেতাদের মনোনীত ছাত্রকে লালন শাহ হলের ডিসেম্বর মাসের জন্য ডাইনিং ম্যানেজার করেননি প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেন। এ ঘটনায় ৩০ নভেম্বর তার সঙ্গে ছাত্রলীগের কয়েক নেতা বৈঠকে বসেন। এ সময় তারা ড. সেলিমকে চাপ দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওইদিনই ড. সেলিম মারা যান।
এ ঘটনায় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ২ ডিসেম্বর বন্ধ ঘোষণা করা হয় কুয়েট। ড. সেলিম প্রতিষ্ঠানটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক।
এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগের কুয়েট শাখা সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ ৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। তবে রোববার পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষক সমিতি সংশ্লিষ্টদের স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করেছে।
করোনা মহামারির অনির্ধারিত ছুটির পর ১০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে কয়েকটি হলে ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতাকর্মী আগের রূপে আবির্ভূত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কর্তৃপক্ষের চাপাচাপিতে স্যার এএফ রহমান হলে ‘গেস্ট রুমে হাজিরা’ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ছাত্রলীগের একটি অংশ। এই সিদ্ধান্তের খুশিতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় ৩ ছাত্রকে বেধড়ক পেটানো হয়। ঘটনাটি ১৮ নভেম্বর রাতের।
এভাবে জিয়া হলে কয়েক শিক্ষার্থীকে মারধর এবং ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে তাদের বের করে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব ঘটনা ছাপিয়ে গেছে রোকেয়া হলে দুই ছাত্রীকে কয়েক ঘণ্টা জোরপূর্বক নাচতে বাধ্য করার ঘটনাটি। অভিযোগটি হচ্ছে-১৬ নভেম্বর রাতে জুনিয়র দুই ছাত্রীকে ‘র্যাগ’ দেওয়ার নামে ওই হলের কয়েক ছাত্রী রাত ১০টা থেকে রাত একটা পর্যন্ত তাদের নাচতে বাধ্য করে।
নাম প্রকাশ না করে ওই হলের এক ছাত্রী জানান, গণমাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হলে কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রলীগের কয়েক জনের চাপের মুখে নির্যাতিত দুই ছাত্রী অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। হলে থাকার স্বার্থে তাদের মুখ বুঝে এভাবে অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
ঢাবি ক্যাম্পাস সূত্রগুলো জানায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ৯২টি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২৮২ শিক্ষার্থী নির্যাতিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জানান, বর্তমানে ছাত্রলীগের হলে কমিটি নেই। যে কারণে আগের মতো দাপট নেই। তবে কয়েকটি হলে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রতিবাদে ২১ নভেম্বর ছাত্র অধিকার পরিষদ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে।
শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও গত কিছুদিন ধরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ অক্টোবর শাহ আমানত ও শাহজালাল হলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষের ৩ জন আহত হন। এর আগে ২ সেপ্টেম্বরও দুই গ্রুপে সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ঘটে। এতে চারজন আহত হন।
রোববার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে শহিদ রফিক জব্বার হলে কক্ষ ও মসজিদে ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের ৪ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের শোকজ করেছে হল কর্তৃপক্ষ।
শনিবার ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে পালটাপালটি ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর সন্ধ্যার দিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য হল বন্ধ ঘোষণা করেছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ক্যাম্পাসে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ।
গত শুক্রবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আনন্দ মোহন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ ইউনিটটি জেলা শাখা ছাত্রলীগের অন্তর্গত হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এরপরই উত্তপ্ত হয়ে উঠে কলেজ।
সূত্র: যুগান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত