বেকারদের চাকরির সুযোগ তৈরির চেয়ে পদোন্নতি নিয়ে ব্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
করোনাভাইরাস মহামারীতে নিয়োগ প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে গেলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি আগের তুলনায় বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সব মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তরের নিয়োগ ও পদোন্নতিসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে, বেকারদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করার চেয়ে নিজেদের পদোন্নতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে অফিস-আদালত থেকে সেবাপ্রার্থীদের সেবা না দেওয়া হলেও তারা নিজেদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন।
গত ১০ বছরের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার সব সময়ই নিয়োগ বেশি দিয়েছে। সেই তুলনায় পদোন্নতি হয়েছে কম। গত বছরের নিয়োগ ও পদোন্নতির অনুপাত ছিল দশমিক ৭৫ঃ১। এর আগের চার বছরে নিয়োগ ও পদোন্নতির গড় অনুপাত ২ঃ১।
২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন ২৪ হাজার ৫৫৩ জন। একই সময়ে পদোন্নতি পেয়েছেন ৩২ হাজার ৭০৯ জন। আগের বছরের তুলনায় করোনাভাইরাস বিস্তারের বছরে পদোন্নতি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। অথচ নিয়োগ কমে অর্ধেকে নেমেছে। আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) সরকারের নিয়োগ ছিল ৪৮ হাজার ৮৮৭টি আর পদোন্নতি ছিল ১৮ হাজার ৫৮৩টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিয়োগ হয়েছে ৪০ হাজার ২৫৮ জনের আর একই সময়ে পদোন্নতি হয়েছে ২২ হাজার ৩৬২ জনের। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিয়োগ ৪০ হাজার ৫৯৯ এবং পদোন্নতি হয়েছে ২৮ হাজার ৩৮৯ জনের। গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮২ হাজার ৫৮৯ জনের। ওই সময় পদোন্নতি পেয়েছেন ৩৭ হাজার ২৭৬ জন।
চলমান করোনা মহামারীর মধ্যে যুগ্ম সচিব পদে দুই দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রথম দফায় ২০২০ সালের ৫ জুন ১২৩ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ২৯ অক্টোবর ২০তম বিসিএস ব্যাচের ২০৩ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব করা হয়। ২৭তম বিসিএস ক্যাডারদের উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয় ২০২১ সালের ৭ মার্চ। এ ব্যাচকে মূল ব্যাচ ধরে ৩৩৭ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব করা হয়। ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সচিব করা হয় ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এ ব্যাচকে মূল ব্যাচ বিবেচনায় ধরে ৯২ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত অর্থনৈতিক ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হওয়া ২২০ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরের দিন ২ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক ক্যাডারের ১৪৩ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক ক্যাডারের ২৫ জনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) অর্থনৈতিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত করা হয়। অর্থনৈতিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে পদোন্নতির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল।
২৭ বিসিএসের ৬৩ কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২০২১ সালের ২ মে। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ২০ ব্যাচের ১৯ কর্মকর্তা পুলিশ সুপার থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ১২ ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিআইজি থেকে অ্যাডিশনাল আইজিপি হয়েছেন।
করোনা মহামারীর মধ্যেই সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় অংশ নেন ৩৪তম বিসিএসের ২ হাজার ১৮৯ কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের অধিকাংশই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। অনুত্তীর্ণরা একই ব্যাচের পাস করা কর্মকর্তাদের চেয়ে নানা সুবিধা থেকে পিছিয়ে পড়েন। এসময় আগের ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার পরও অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। উত্তীর্ণ হওয়া বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে উত্তীর্ণ না হলে বেতন-ভাতা বাড়ে না, রাষ্ট্রীয় কাজও ব্যাহত হয়।
করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তার ঠেকাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপরও ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখা হয়। কখনো কখনো সীমিত অফিস বা ভার্চুয়ালি বৈঠক করে শাসন ও বিচারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়। এসময় সব নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে থাকায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে দুই দফায় মোট ২৬ মাস বয়স ছাড়ের সুযোগ দেয় সরকার। গত বছরের ১৯ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২১ মাস বয়স ছাড় দিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে যাদের চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর পার হয়েছে, তাদের গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জারি করা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারীর প্রথম দফায় সাধারণ ছুটির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত চাকরিপ্রার্থীদের বয়সের ক্ষেত্রেও ৫ মাস ছাড় দিয়েছিল সরকার। নিয়োগ প্রক্রিয়া আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হলেও করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়া থমকে গেছে। বিসিএসসহ অনেক নিয়োগ পরীক্ষা ইতিমধ্যেই পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বেকারদের দুর্ভোগ লাঘবের পথ রুদ্ধ হলেও সচলই ছিল সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। প্রশাসন ক্যাডারের মতো নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন পুলিশ, কাস্টমস, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যসব ক্যাডার কর্মকর্তারা। ক্যাডার কর্মকর্তাদের বাইরে প্রথম শ্রেণির সব কর্মকর্তারাও পদোন্নতি পেয়েছেন। বাদ যাননি দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। সিনিয়র স্কেলের পদোন্নতি পরীক্ষাও হয়েছে এসময়।
মহামারীর কারণে ২০২০ সাল থেকে গোটা পৃথিবী শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ সময় পার করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল লিংক, কর্ণফুলী রোড টানেল এবং বৃহত্তর ঢাকা টেকসই আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গত বছরের এক সমীক্ষায় বলেছে, প্রায় ৫৭ শতাংশ লোক বলেছেন যে মহামারীকালে তাদের কোনো বেতন নেই, ৩২ শতাংশ লোকের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং মাত্র ১১ শতাংশের স্থিতিশীল আয় ছিল।
কভিড সংকটের মাঝে জনগণের চাহিদা অনুসারে তাদের সেবা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেশের ৫০ লাখ কর্মহীন পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর আড়াই হাজার টাকা ‘ঈদ উপহার’ দেওয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি ব্যাপক অনিয়মে প্রকৃত অভাবীদের তালিকা তৈরির ব্যর্থতার কারণে। প্রতি জেলায় ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিযুক্ত সচিবদের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি দরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পরই ব্যাপক অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে তা স্থগিত রাখতে বাধ্য হতে হয়।
বেসরকারি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মহামারীর তান্ডবে দেশের সাধারণ মানুষ যখন এক বড় সংকটে নিপতিত, ঠিক তখনই পদোন্নতি দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা। এর ফলে যেসব করদাতার টাকায় এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দেওয়া হয় তাদের কষ্ট বেড়েছে। ভয়ংকর এ সময়টাতে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ মানবিক হয়েছে। অথচ আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। যা হওয়ার নয়, তাই হয়ে গেছে।’
এখন সঠিক পথে আসা উচিত এই মন্তব্য করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকারের লাখ লাখ পদ খালি। এসব পদে দ্রুত নিয়োগ দিয়ে বেকারদের কষ্ট লাঘব করতে হবে। শুধু চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশই যথেষ্ট নয়। সব প্রক্রিয়া শেষ করে নিয়োগ পেতে পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) সুপারিশ করার পরও নিয়োগ দেয় না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য চাকরি আটকে থাকে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমনটা হয় না। সরকারের কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলেই এসব ক্ষেত্রে সংস্কার করতে পারেন।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত