ভাইরাল জলকুণ্ডলী আসলে কী ছিল এবং যে কারণ হয়
শনিবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারে এশিয়ার সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকিতে জলস্তম্ভ (জলকুণ্ডলী) দেখা যায়। হাকালুকির বার হালি চাতলা বিল নামক স্থানে হঠাৎ হাওরের পানি কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠে যায়। অবাক করা এ ঘটনা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
বিষয়টি নানান জন নানান ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। এ ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ।
তিনি বলেন, শনিবার মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের উপর একটি টর্নেডো হয়েছে। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরে যে অতি-প্রাকৃতিক ঘটনাটি ঘটেছে, আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় সেটিকে ‘ওয়াটারস্পাউট’ বা জলজ টর্নেডো বলে।
মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা জানি গ্রীষ্মকালে সূর্য থেকে আসা তাপের কারণে খাল-বিল-নদীর পানি বাষ্পায়িত হয়ে জলীয়বাষ্প আকারে আকাশে উড়ে যায়। কোনো স্থল বা জলভাগের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা তার চারপাশের স্থানের চেয়ে অত্যধিক বেশি বেড়ে গেলে ভূপৃষ্ঠের বা জলভাগের ওপরের বায়ু প্রচণ্ড গরম হয়ে চারপাশের বায়ু অপেক্ষা ঘনত্ব কমে যায়। গরম ও হালকা বায়ু তখন আকাশের ওপরের দিকে উঠে যায়, ঠিক যেমন হিলিয়াম বা হাইড্রোজেন বায়ু যুক্ত বেলুন আকাশে উড়ে যায়।
‘আপনি প্রশ্ন করতে পারেন- প্রতিদিনই পানি বাষ্পায়িত হয়ে জলীয়বাষ্প আকারে আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু প্রতিদিন তো উপরে উল্লেখিত ঘটনা ঘটে না। আপনার প্রশ্ন সঠিক। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরে যে ঘটনা ঘটেছে প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনা দেখা যায় না। কারণ এ ঘটনা ঘটার জন্য যে প্রাকৃতিক শর্ত পূরণ করতে হয় সেরকম পরিবেশ সবসময় দেখতে পাওয়া যায় না।’
ওয়াটারস্পাউট বা জলজ টর্নেডো সৃষ্টির জন্য প্রকৃতিকে চারটি আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয় জানিয়ে এ আবহাওয়া গবেষক বলেন, বায়ুর উচ্চ তাপমাত্রা, বায়ুতে পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি, বায়ু প্রবাহের দিক ভূপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে ও প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক বলের উপস্থিতি থাকতে হয়। শনিবার হাকালুকি হাওরে উপরোক্ত চারটি শর্তই উপস্থিত ছিল। যেহেতু গত মাসের বন্যার পর থেকে পুরো বাংলাদেশে খুবই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে তাই বায়ুর তাপমাত্রা অনেক বেশি রয়েছে। এক সপ্তাহ পূর্বে দেশের আকাশ ছিল প্রায় মেঘমুক্ত ও দেশের উপর দিয়ে তাপপ্রবাহ অতিক্রম করেছে। ফলে সিলেটের হাওর এলাকার পানির তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, শনিবার সিলেট বিভাগের ওপর বায়ু বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। যেমন ভূপৃষ্ঠ থেকে এক কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল দক্ষিণ দিক থেকে। এক থেকে দুই কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। দুই থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল পূর্ব দিক থেকে। ভূপৃষ্ঠে বায়ুচাপ থাকে সর্বোচ্চ ও ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে বায়ু চাপ কমতে থাকে। সেই সঙ্গে বায়ুর মধ্যে ঘর্ষণ বলও কমতে থাকে। ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে ওঠা যাবে বায়ু তত বেশি গতিতে প্রবাহিত হতে থাকবে। কোনো স্থানে যখন বায়ু বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয় ও একই সময়ে বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুর গতিবেগ ভিন্ন হয়, তখন ওই স্থানের বায়ুর মধ্যে ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়।
মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, এ বিষয়টি স্থলভাগে সংঘটিত হলে আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হতো টর্নেডো। টর্নেডো খুব শক্তিশালী হলে যেমন বড় বড় বস্তুও আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যায়, ঠিক একইভাবে ওয়াটারস্পাউট জলভাগ থেকে মাছ-ব্যাঙসহ অন্যান্য জলজপ্রাণী আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ওয়াটারস্পাউটের ফলে সৃষ্ট জলীয় বাষ্প যখন অন্য স্থানে বৃষ্টি হিসেবে ভূমিতে পতিত হয়, তখন ওই বৃষ্টির সঙ্গে সেসব মাছ ও ব্যাঙ ভূপৃষ্ঠে পড়ে।
এ আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক আরও বলেন, মাঝে মধ্যে আমরা শুনে থাকি বা পত্রিকায় পড়ে থাকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৃষ্টির সঙ্গে মাছ, ব্যাঙ পড়েছে। আমাদের দেশেও একই রকম ঘটনা ঘটলে গ্রাম-বাংলার মানুষ বলে থাকে প্রকৃতির লিলাখেলা। এ পর্যন্ত আকাশ থেকে পড়া সবচেয়ে বড় মাছটি ছিল প্রায় ৬ পাউন্ড, যা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোনো স্থানে রেকর্ড করা হয়েছে বলে বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণাপত্র ‘সাইন্স’র প্রবন্ধে পাওয়া যায়।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত