মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের যে ১৬৭২ কিমি সড়ক
দেশে মোট সড়ক ২১ হাজার ৫৯৫ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার। জাতীয় মহাসড়ক ৩ হাজার ৯০৬ ও আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪ হাজার ৪৮২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার। ১৩ হাজার ২০৬ দশমিক ৯২৩ কিলোমিটার জেলা সড়ক। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৭২ কিলোমিটার সড়ক ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বসানো হচ্ছে প্রযুক্তি। কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এতে পার পাবেন না চালকরা। এ উদ্যোগে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার কিলোমিটার সড়ক নিরাপদ করা।
এডিবি বলছে, বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে তাই ‘বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প’ হাতে নিচ্ছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), হাইওয়ে পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস)।
সমন্বিত নিরাপদ সড়ক প্রণয়নে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সরকার। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় মোট ৪ হাজার ৩১৫ কোটি ৫৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ঋণ ৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারি খাত থেকে আসবে। চলতি সময় থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ১ হাজার ৬৭২ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ১ হাজার ৩৭২ কিলোমিটার জাতীয় ও ৩০০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক। প্রকল্পের আওতায় এর মধ্যে জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার ও নাটোর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সড়কে প্রাথমিকভাবে বসানো হচ্ছে স্বয়ংক্রিভাবে নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ ডিভাইস। এতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে কোনো চালক পার পাবে না।
সওজ জানায়, প্রকল্পের আওতায় অগ্রাধিকারভিত্তিতে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়নে পাঁচ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নিরাপদ করা হবে। তথ্যের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার বিবেচনায় বিভিন্ন ইন্টার সেকশনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাত্রার পূর্ত কাজের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ অন্য সংস্থার ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা হবে জাতীয় ডাটা সিস্টেম। জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা ও নাটোর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটার মহাসড়কে বসানো হবে সিসিটিভি। স্থাপন করা হবে ইন্টিগ্রিটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনসিডেন্ট ডিটেকশন সিস্টেম। কেউ যদি বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় এবং কোনো দুর্ঘটনা ঘটায় তবে স্বয়ংক্রিভাবে ধরা পড়বে।
এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের দক্ষতা উন্নয়নে মাদারীপুরের শিবচরে হাইওয়ে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হবে প্রকল্পের আওতায়। তিনটি হাসপাতালে (টাঙ্গাইল জেলারেল হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতাল) ট্রমা রেজিস্ট্রি সিস্টেম চালু করা হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিএ) আওতাধীন মোটরযান রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্সিং ও ফি পরিশোধ সংক্রান্ত ইনফরমেশন সিস্টেম করা হবে একীভূত। এজন্য পরামর্শ সেবাসহ বিভিন্ন কর্মশালায় চালকদের প্রশিক্ষণ এবং সড়ক নিরাপত্তামূলক বিষয়ে প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধিও এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত কার্যক্রম।
স্বয়ংক্রিভাবে নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ ডিভাইস প্রসঙ্গে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (টেকনিক্যাল সার্ভিস) ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কোনো প্রযুক্তি আমেরিকায় আসার পরই আমাদের দেশেও চলে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। এই প্রযুক্তি স্থাপনের ফলে স্বয়ংক্রিভাবে নম্বর প্লেটের ছবি তোলা হয়ে যাবে। ফলে কোনো চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পার পাবে না। যানবাহনের অবস্থানও শনাক্ত করা যাবে। জিপিএস সিস্টেমের মতো ধরা পড়বে রিডারের মাধ্যমে।
সওজ জানায়, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে গুরুতর জখম ও মৃত্যু বাংলাদেশের একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি লাখে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ১৫ জনের বেশি, যা উন্নত দেশের তুলনায় তিনগুণেরও অধিক। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ২ থেকে ৩ শতাংশ। জাতিসংঘের ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা কমিয়ে আনা। ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সুলভ ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থায় সবার প্রবেশধিকার নিশ্চিত করাও লক্ষ্য।
বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত রোড সেফটি প্রোগ্রামের আওতায় প্রথম পর্যায়ের একটি প্রকল্প এটি। প্রকল্পটির কার্যক্রম তিনটি অংশে বিভক্ত।
দুর্ঘটনা রোধে সড়কে নিরাপত্তা কাজ
প্রকল্পের আওতায় জাতীয়, জেলা ও নগর এলাকার সড়কে বহু সংস্থার সমন্বয়ে পাইলট আকারে সড়ক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার ও নাটোর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সড়কাংশে পরীক্ষামূলকভাবে সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন ইন্টারসেকশন উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাধ্যমমানের পূর্ত কাজ, সড়ক প্রশস্তকরণ, পার্কিং এরিয়া নির্ধারণ, রোড মার্কিংসহ বিভিন্ন ট্রাফিক সাইন সিগন্যালের উন্নয়ন। থাকবে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়াসহ বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স।
নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ ও সড়কে সিসিটিভি
প্রকল্পের আওতায় সড়কে সিসিটিভি ও নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ মেশিন স্থাপন করা হবে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে সড়ক নিরাপত্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে পাঁচ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নিরাপদ করা হবে। জাতীয় মহাসড়কের ১৪০ কিলোমিটার অংশে স্বয়ংক্রিয় নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ প্রযুক্তি বসানো হবে।
কারিগরি সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানো হবে। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানো, ন্যাশনাল রোড সেফটি অথরিটি (এনআরএসএ) ব্লু প্রিন্ট প্রস্তুতকরণ, রোড সেফটি অডিট অ্যাক্রিডিটেশন সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত