মোবাইল ছিনতাইয়ের পর জিডি করলে পুলিশ যেভাবে উদ্ধার করে
কোনও থানা নিজস্ব প্রচেষ্টায় চোরাই মোবাইল উদ্ধার করতে পারে না। এ জন্য থানাকে নির্ভর করতে হয় ঊর্ধ্বতন অফিসের ওপর। কারণ মোবাইলের অবস্থান শনাক্ত ও তাতে ব্যবহার করা সিমের মালিকের পরিচয় বের করার প্রযুক্তি থানায় থাকে না। এ ছাড়াও প্রযুক্তির সহায়তায় যেভাবে ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে মোবাইলটিকে ট্র্যাকিং করা হয়, সেই প্রক্রিয়াটিও স্পর্শকাতর। সকল পুলিশ কর্মকর্তাদের সরাসরি এ ধরনের তথ্য চাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
নির্দিষ্ট কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ধৈর্য্য ধরে সে তথ্য নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের লেগে থাকতে হয়। এরপর চোরাই মোবাইল উদ্ধারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে যদি ফোনটা চালু না থাকে বা দেশের বাইরে চলে যায় তবে সেটি আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
জিডিতে যা থাকতে হবে
জিডিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তার পরিচয়, ফোনের মডেল, ফোন নম্বর ও আইএমইআই নম্বর এবং মেইল খোলা থাকলে মেইল আইডিও লেখেন কেউ কেউ। আইএমইআই নম্বর ভুলে গেলেও সমস্যা হয় না। মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে সেটা উদ্ধার করা যায়। তবে তাতেও সময়ক্ষেপণ হয়।
ঢাকায় কী পরিমাণ মোবাইল হারায়?
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানায় প্রায় প্রতিদিনই মোবাইল হারানোর জিডি হচ্ছে। কোনও থানায় দিনে ১৫-২০টি জিডি হওয়ার রেকর্ডও আছে। তবে ডিএমপিতে নির্দিষ্ট হিসাব নেই। জিডির পর মোবাইল ফোন ফিরে পাওয়ার ঘটনা সামান্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও হদিস মেলে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
থানার সহযোগিতা পান না অনেকেই
গত ২০ অক্টোবর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকা দিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন বাবু আহমেদ। বাইরে থেকে ছোঁ মেরে তার দুটি দামী মোবাইল নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। এই ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় তিনি মোবাইল হারানোর জিডি করেন। তবে আজ পর্যন্ত ফোন দুটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। দুই মাসে থানা থেকে আপডেটও জানানো হয়নি।
অক্টোবরে করা বাবুর জিডির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার সহকারি উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি জিডিতে থাকা আইএমইআই নম্বর দিয়ে ফোনটির কললিস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ওসি স্যারের মাধ্যমে চেয়েছি। কললিস্ট এখনও আসেনি। এজন্য দেরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘মোবাইলটি খোলা থাকতে হবে। তবেই কললিস্ট পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক সময় মোবাইল বন্ধ রাখা হয়। আবার কেউ দামী মোবাইলের যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে। কেউ কেউ ওই ফোনে সিম ব্যবহার না করে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এ ছাড়া একটি চক্র আবার আইএমইআই নম্বর বদলে ফেলে।’
এ বছরের ২৪ জুলাই বরিশালের গৌরনদীতে মোবাইল হারান রাকিব সরদার। গৌরনদী থানায় এ নিয়ে জিডি হয়। মোবাইলটি ঢাকার একটি বাড়িতে শনাক্ত হয়। সেখান থেকে ফোনটি উদ্ধারের জন্য তিনি আদাবর থানা পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাহিদুজ্জামানের সঙ্গে গত ৮ সেপ্টেম্বর, ৯ সেপ্টেম্বর ও ১৪ সেপ্টেম্বর দেখা করেন। তবে সহায়তা করেনি আদাবর থানা। ব্যবহারকারীর বাড়ির ঠিকানা দেওয়ার পরও ফোন উদ্ধার করেনি পুলিশ। পরে রাকিব তার মোবাইলে ব্যবহারকারীর নম্বরটিতে ফোন করে কৌশলে তার পরিচয় বের করেন।
তিনি জানতে পারেন, ওই ব্যবহারকারীর বাড়ি রাকিবের বাড়ির পাশেই। তিনি মোবাইলটি একজনের কাছ থেকে কিনছেন বলে জানান। এরপর গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমেই মোবাইলটি ঢাকা থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে উদ্ধার হয়।
সবসময় উদ্ধার করা সম্ভব?
প্রযুক্তিবিদ তানভীর জোহা বলেন, ‘চুরি, ছিনতাই বা হারিয়ে যাওয়া মোবাইল উদ্ধার সবসময় নাও হতে পারে। তবে মোবাইলটি দেশে থাকলে এবং সেটি কেউ ব্যবহার করলে শনাক্ত করা সম্ভব। যদি ছিনতাই চক্র মোবাইলের নেটওয়ার্ক আইসি বদলে আইএমইআই নম্বরও বদলে ফেলে, তবে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।’
ব্যতিক্রম এএসআই আব্দুল কাদের
বছর পাঁচেক আগে এক নারীর হাত থেকে তার বাবার স্মৃতি বিজড়িত একটি মোবাইল ফোন হারিয়ে যায়। ওই নারীর কান্না দেখে আবেগাপ্লুত হন এএসআই আব্দুল কাদের। সেই থেকে মানুষের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছেন আব্দুল কাদের। এখন তিনি ডিএমপির গুলশান থানায় এএসআই। গত পাঁচ বছরে হারানো ও ছিনতাই হওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছেন তিনি।
অন্য থানার ভুক্তভোগীরাও এখন তার কাছে যায়। তিনি ডিএমপির রমনা, তেজগাঁও, নিউমার্কেট ও গুলশান থানায় কর্মরত ছিলেন। কিছুদিন র্যাবেও কাজ করেছেন।
আব্দুল কাদের বলেন, ‘চোরাই মোবাইল উদ্ধার এখন আমার নেশা হয়ে গেছে। দিনে ঘণ্টা চারেক ঘুমাই। সারাদিন এর পেছনে লেগে থাকি। থানার সাধারণ রোস্টারের ডিউটির পর মোবাইল উদ্ধারে কাজ করি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সহযোগিতা করেন।’
তিনি বলেন, ‘কাজটি বেশ ধৈর্যের। পুলিশের নিয়মিত অনেক কাজ থাকে। তাই এ কাজে সময় দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এমন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আব্দুল কাদের ১৬ বার পুলিশ কমিশনার পুরস্কার পেয়েছেন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত