যেভাবে চলছে বিআরটিএ
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নিজ দপ্তরে যতটা ডিজিটাল, বাইরে তার ছিটেফোঁটাও নেই। এখন করের টাকা, নিবন্ধন ফি অনলাইনে দেওয়া যায়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য কিংবা গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য সময় নির্ধারণও করা যায় অনলাইনে। পাশাপাশি বিআরটিএর দপ্তর ব্যবস্থাপনাতেও ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। কিন্তু এই কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে যে সড়ক, সেখানে সেই পুরোনো বিশৃঙ্খলা, হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বাসে বাসে মরণ প্রতিযোগিতা, আর প্রতিদিন রক্তাক্ত রাজপথ। টিকিট লেনদেন, গাড়ি চলাচল ব্যবস্থাপনা, ফিটনেস, পার্কিং সবই চলে পুরোনো অ্যানালগ পদ্ধতিতে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাগজে-কলমে সড়কের নিয়ন্ত্রণে সরকারি কর্তৃপক্ষ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এটি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া একটি চক্রের মাধ্যমে। এ কারণে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের বড় আন্দোলনের সময় সরকার নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও রক্ষা করতে পারেনি। বরং বেপরোয়া বাসের দৌরাত্ম্য, বাসে বাসে রেষারেষি এখন আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সহজ সড়ক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। দুর্ঘটনার ঝুঁকিও অনেকখানি নিরসন সম্ভব। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর সড়ক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনাই দেখা যাচ্ছে না।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের এক যুগে কতটা ডিজিটাল হয়েছে গণপরিবহন?- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, এখন দূরপাল্লার অনেক বাসে অনলাইন টিকেটিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। রাজধানীতে কয়েকটি বাসে পস (পিওএস-পয়েন্ট অব সেলস) মেশিনের মাধ্যমে টিকিট দেওয়া হচ্ছে।
পরিবহন খাতের প্রভাবশালী এই নেতার কথার সূত্র ধরে সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীতে তিনটি রুটে এসি বাসে কাগজের টিকিট পিওএস মেশিন থেকে দেওয়া হয়। এ ছাড়া গুলশান এলাকার ভেতরে চলাচল করা ‘গুলশান চাকা’ বাসের টিকিট পিওএস মেশিনে দেওয়া হচ্ছে। যাত্রীরা কাউন্টার থেকে টিকিট নেওয়ার পর বাসে ওঠার সময় বাসের সহকারী সেই কাগজের টিকিট নিয়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। রাস্তাজুড়ে ছেঁড়া টিকিটের স্তূপে অপরিচ্ছন্ন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ছাড়া রাজধানীর অন্য সব রুটে লোকাল কিংবা সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলা বাসে যাত্রীদের টিকিটই দেওয়া হয় না। পুরোনো পদ্ধতিতে চালকের সহকারী যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেন। কিছু বাস সার্ভিসে রাস্তার মাঝখানে ‘চেকিং’ ব্যবস্থা আছে। বাস কর্তৃপক্ষের একজন ব্যক্তি গাড়িতে উঠে যাত্রীর মাথা গুনে ওয়েবিলে সই করেন। প্রগতি সরণিতে রাইদা পরিবহনের একটি চেকিং পয়েন্টে কে আগে দাঁড়াবে তা নিয়েও একই কোম্পনির একাধিক বাসের মধ্যে প্রতিযোগিতাও দেখা যায়।
শুধু দূরপাল্লায় চলাচল করা কিছু বাস সার্ভিসে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা আছে। কয়েকটি অ্যাপভিত্তিক অনলাইন টিকেটিং সার্ভিস আছে, যারা বিলাসবহুল বিভিন্ন বাসের টিকিট দিয়ে থাকে। এর বাইরে অধিকাংশ বাস সার্ভিসে অনলাইন টিকেটিং নেই।
মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে অনলাইনে বা আগাম টিকিট বুকিংয়ের ব্যবস্থা সীমিত। যাত্রীকে টার্মিনালে এসে তাৎক্ষণিকভাবে টিকিট কাটতে হয়।
যদিও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির মনে করেন, বাস ও ট্রেনের টিকিট অনলাইনে দেওয়াকে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা বলা অর্থহীন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই রয়েছে, যেগুলোতে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
রাজধানীর সড়কগুলোর সিগন্যাল ব্যবস্থাপনাও পুরোনো যুগের। ঢাকায় শতাধিক স্থানে বিভিন্ন সময়ে সিগন্যাল বাতি বসানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গুলশান-১ ও ২ নম্বর গোল চত্বর ছাড়া আর কোথাও স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু নেই। বেশিরভাগ মোড়েই ট্রাফিক বাতি জ্বলে না। কোথাও কোথাও কালেভদ্রে বাতি জ্বললেও সেই বাতির কোনো কাজ নেই। সব সড়কেই ট্রাফিক পুলিশকে হাতের ইশারায় গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘ঢাকা ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশেই এভাবে হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা দেখিনি।’
তিনি বলেন, যদি অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য রুটের সৃষ্টি না করে যৌক্তিকভাবে প্রয়োজন বিবেচনায় রুট নির্ধারণ করা হতো, তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি চালু রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য রুটের কারণে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, এর কারণেই ডিজিটাল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা কিংবা দু-একবার চেষ্টা করেও চালু রাখা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থা ডিজিটাল করার সুযোগ আছে। যেমন- একটি কার্ডের মাধ্যমে কিংবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বাসের, ট্রেনের কিংবা ওয়াটার ওয়ের ভাড়া পরিবহনের ব্যবস্থা গড়ে তোল যায়। এ ধরনের ব্যবস্থা এশিয়ার অনেক দেশেই আছে। আবার জিপিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। অন্তত রাজধানীতে এ ব্যবস্থা গড়ে তুললে কোন গাড়ি কতটা বিশৃঙ্খলভাবে চলছে, গতিসীমা লঙ্ঘন করেছে কিনা, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার কারণ এবং প্রকৃত দায়ীকে তা সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব খুব সহজে।
সুমন আহমেদ বলেন, কোনো গাড়ির ফিটনেসে সমস্যা থাকলে সেটাও প্রযুক্তির মাধ্যমে তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একই সঙ্গে প্রত্যেক রুটের ডাটাবেজ থাকলে কোন রুটে কত গাড়ি চলছে, কোন পয়েন্ট থেকে কোন গাড়ি ছেড়ে গিয়ে কীভাবে অন্য প্রান্তে পৌঁছল, তাও ডিজিটাল ব্যবস্থায় তদারক করা সম্ভব। কিন্তু সে ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই, কেউ চিন্তা করছে বলেও মনে হচ্ছে না।
তার মতে, তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর ডিজিটাল গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা দরকার, পরিকল্পনা করা দরকার, তা অনুপস্থিত। এজন্য বারবার অস্থায়ীভিত্তিতে বিশৃঙ্খলভাবে পরিকল্পনা নেওয়ার কারণে গণপরিবহনে নূ্যনতম ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা আসেনি।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রধান ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে বহু বছর ধরে উচ্চকণ্ঠ চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, গণপরিবহন ব্যবস্থায় ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হলে গণপরিবহন ব্যবসায়ী ও সরকার দু’দিক থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সার্বিকভাবে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে, দুর্ঘটনা কমবে। এজন্য ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বিআরটিএ চেয়ারম্যানের বক্তব্য: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সমকালকে বলেন, সড়কে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ চলছে। রুট র্যাশনালাইজিং বা রুট ফ্রাঞ্চাইজির কাজ চলছে। এটা হয়ে গেলে অবশ্যই সড়কে শৃঙ্খলার মান উন্নত হবে, যানজটও কমবে।
সূত্র: সমকাল
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত