যে কারণে যানজট লেগেই থাকে মহাসড়কগুলোতে

দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে মহাসড়কগুলো কার্যত মহাসড়ক হয়ে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানে এসব সড়কের পাশে গড়ে ওঠা হাটবাজার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সারা দেশের ৮ হাজার ৮৮৭টি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ছোট-বড় ১০ হাজারেরও বেশি দোকান নিয়ে অন্তত ২৭৫টি স্থায়ী, অস্থায়ী এবং অবৈধ হাটবাজার গড়ে উঠেছে-যা মহাসড়কের ‘বিষফোড়ায়’ রূপ নিয়েছে।
এসব হাটবাজার ঘিরে পণ্য পরিবহণ, থ্রি-হুইলারের চলাচল, বাস-ট্রাকস্ট্যান্ড ও মানুষের চলাফেরা কমাচ্ছে গাড়ির গতি। যত্রতত্র মানুষের রাস্তা পারাপারে ঘটছে দুর্ঘটনা, মরছে মানুষ।
শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজারের ইজারা দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ। বিভিন্ন সময়ে মহাসড়কসংলগ্ন দোকানপাট উচ্ছেদ করা হলেও কিছুদিন পরই বিভিন্ন পক্ষের সমঝোতায় তা আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এ কারণে সৃষ্ট যানজটে ১০ মিনিটের রাস্তা পার হতে পরিবহণগুলোর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগছে। এতে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে সময়ের অপচয়।
দৈনিক যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান, হাইওয়ে পুলিশ এবং সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায় উল্লিখিত সব তথ্য। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মহাসড়কের ন্যাচার (বৈশিষ্ট্য) অনুযায়ী সেখানে হাটবাজার থাকার কোনো সুযোগ নেই। মহাসড়কের পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতেও দোকানপাট শোভনীয় হয় না। সেটি পাবলিক ইন্টারেস্টের (জনস্বার্থ) কারণে। হাটবাজার হলেই তাকে ঘিরে মানুষের সমাগম হয়, নানা ধরনের সমস্যা হয়। সড়ক ও জনপথের জায়গায় যেসব হাটবাজার আমরা উচ্ছেদ করি, কিছুদিন পর দেখা যায়, সেগুলো আবার বসছে। হাটবাজারের ট্রাফিক এড়াতে অনেক সময় আমরা লিংক রোড করে দিই। এই রোডকে কেন্দ্র করে আবার জীবন-জীবিকার কার্যক্রম শুরু হয়, যা হওয়া উচিত নয়। আইন অনুযায়ী, মহাসড়কের প্রান্তসীমা থেকে ১০ মিটারের মধ্যে নিজের জমি হলেও স্থাপনা করা যাবে না। এক্ষেত্রে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে থেকে অনুমতি নিয়ে করতে হবে। এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা গেলে এই অবস্থার অনেকটা উন্নতি হবে।
আইনে যা আছে : ‘মহাসড়ক আইন, ২০২১’-এর ৯ ধারায় মহাসড়ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের ১১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘মহাসড়কের সংরক্ষণ রেখার মধ্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাইবে না।’ ১২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের পূর্বানুমোদন ব্যতীত, মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ রেখার মধ্যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ, হাটবাজার বসানো বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মহাসড়কের কোনো অংশ ব্যবহার করা যাইবে না।’ এই আইনে মহাসড়কের সংজ্ঞায় এর প্রান্তসীমা বা ‘রাইট অব ওয়ে’কে মহাসড়কের ভূমি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আইনের দুই ধারার ১৬ উপধারায় মহাসড়কের উভয় পাশের ভূমির প্রান্তসীমা থেকে ১০ মিটার অথবা সরকার কর্তৃক গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্ধারিত রেখাকে ‘সংরক্ষণ রেখা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনে সংরক্ষণ রেখা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। অথচ এই আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে হাটবাজার।
বিশেষজ্ঞ মন্তব্য : পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। সেখানে চাইলেই যে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। গাড়ি চলবে উচ্চগতিতে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে। যেখানে নন-মোটর অ্যাকটিভিটির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশে যেসব রাস্তাকে মহাসড়ক বলা হচ্ছে, সেগুলোকে ভালো রাস্তা বলা গেলেও মহাসড়ক বলার সুযোগ নেই। এর প্রধান কারণ মহাসড়কের হাটবাজার। বাধাহীনভাবে গাড়ি চলার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় এসব হাটবাজার, যা মহাসড়কের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। এসব হাটবাজারকে কেন্দ্র করে বছরভেদে ২৮ থেকে ৩৪ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, হাইওয়ে নাম থেকেই বোঝা যায় এটি হবে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ধমনি রোড। কিন্তু এই রোডে হাটবাজারের মতো ব্লকগুলো তৈরি হচ্ছে। একটা সময়ে স্থানীয় মানুষ এই ব্লকগুলো তৈরি করত। কিন্তু এখন দেখছি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন বলে দিয়েছে যে স্থানীয় প্রশাসন যেন স্বনির্ভর হয়। তাদের আয় যেন তারাই করতে পারে। তখনই এই ইউএনওরা লিজ মানি পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশে যারা ব্যক্তি উদ্যোগে মার্কেট করতে চায় সেগুলোর ‘পেরিফেরি ডিক্লেয়ার’ করে দিচ্ছে। মার্কেট একবার বসে গেলে সেটা আর সরানো যায় না। এক গবেষণার মাধ্যমে মহাসড়কে এমন ২২১টি ব্ল্যাক স্পট আমরা নির্ধারণ করেছি, যা টোটাল ন্যাশনাল হাইওয়ের মাত্র ৪ শতাংশ। কিন্তু মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ শতাংশই ঘটে এসব স্থানে। দুর্ঘটনা ও নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত নিশ্চিতে বাজার এড়াতে বাইপাস তৈরি করতে হচ্ছে। আবার বাইপাস ঘিরে হচ্ছে হাটবাজার। ফলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
হাটবাজার উচ্ছেদের হালচাল : হাইওয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা রিজিয়নে মহাসড়কে ৬৯টি হাটবাজার রয়েছে। এই অঞ্চলে গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫০১টি অভিযান পরিচালনা করে মহাসড়ক এলাকা থেকে ৩২১টি অস্থায়ী কাঁচামাল ও ফলের দোকান অপসারণ করা হয়েছে। গাজীপুর রিজিয়নের আওতাধীন মহাসড়কে ৪১টি স্থায়ী, অস্থায়ী ও অবৈধ হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টিকে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বগুড়া রিজিয়নে মহাসড়কে ৬১টি হাটবাজার রয়েছে। গত এক বছরে এখানে কোনো অবৈধ হাটবাজার উচ্ছেদ হয়নি। মাদারীপুর রিজিয়নে ২৯টি হাটবাজার রয়েছে। এই অঞ্চলে মাত্র দুটি দোকান উচ্ছেদ করতে পেরেছে হাইওয়ে পুলিশ। সিলেট রিজিয়নে মহাসড়কে ৭৫টি হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে ১২টিকে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ব্র্যাক রোড সেফটি প্রোগ্রামের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসেন বলেন, বাজারগুলো উচ্ছেদের কথা বলা হয়, আবার কিছুদিন পরই তা দখল হয়ে যায়। এজন্য কেবল উচ্ছেদ করেই দায় না সেরে এগুলোর তদারকি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং উচ্ছেদের স্থানে আনসার মোতায়েন করা যেতে পারে। যাতে পুনরায় বাজার স্থাপন না হয়।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মল্লিক ফখরুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কের অবৈধ হাটবাজার উচ্ছেদে আমরা অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে আছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। উচ্ছেদের পর যাতে নতুন করে সেই জায়গাগুলো দখল না হয়ে যায়, সেজন্য নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। সড়কে দুর্ঘটনা রোধসহ সামগ্রিক শৃঙ্খলা ফেরাতে আমাদের তৎপরতা রয়েছে। পাশাপাশি মহাসড়ক আইন বাস্তবায়নেও আমরা বদ্ধপরিকর।
মহাসড়কে যত হাটবাজার-
কুমিল্লা রিজিয়ন : এই অঞ্চলের মহাসড়কের ৬৯টি হাটবাজারের মধ্যে ৫৮টি স্থায়ী ও ১১টি অস্থায়ী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সর্বোচ্চ ২৭টি হাটবাজার রয়েছে, যার ২০টি স্থায়ী এবং ৭টি অস্থায়ী। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ২১টি স্থায়ী এবং ৪টি অস্থায়ীসহ ২৫টি হাটবাজার আছে। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫টি, নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে ৯টি এবং চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩টি হাটবাজার রয়েছে। এর সবকটিই স্থায়ী হাটবাজার।
গাজীপুর রিজিয়ন : এখানে মোট ৪১টি হাটবাজারের মধ্যে ইজারা দেওয়া স্থায়ী হাটবাজার রয়েছে ১৫টি, অস্থায়ী রয়েছে একটি এবং উচ্ছেদ হওয়া অবৈধ হাটবাজারের তালিকায় রয়েছে ২৫টি। উচ্ছেদ হওয়া হাটবাজারগুলোর অধিকাংশই কিছুদিন পর থেকে পুরোদমে চলছে। এই অঞ্চলের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ১৩টি হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে ৫টি বাজার উচ্ছেদ করে হাইওয়ে পুলিশ। গাজীপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৪টি হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৬টি হাটবাজার রয়েছে। সেগুলোয়ও উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৫টি বাজার রয়েছে। এই রিজিয়নের অন্তর্ভুক্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হাটবাজার রয়েছে ৯টি। এছাড়া কদমতলী-নন্দীর বাজার ভায়া শেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে রয়েছে বকশিগঞ্জ গরুর হাট। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে রয়েছে তিনটি বাজার।
বগুড়া রিজিয়ন : এই অঞ্চলে মহাসড়কে ৬১টি হাটবাজারের ৬০টিই স্থায়ী এবং একটি অস্থায়ী। এর মধ্যে হাটিকুমরুল-ঢাকা মহাসড়কে একটি, হাটিকুমরুল-বগুড়া মহাসড়কে পাঁচটি, সিরাজগঞ্জ-নাটোর মহাসড়কে একটি, কাশিনাথপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কে আটটি, বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে তিনটি, পাবনা-নাটোর মহাসড়কে সাতটি, সিরাজগঞ্জ-নাটোর মহাসড়কে দুটি, বনপাড়া-রাজশাহী মহাসড়কে তিনটি এবং নাটোর-কুষ্টিয়া মহাসড়কে রয়েছে দুটি। রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে রয়েছে ১০টি, রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কে একটি, রংপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কে ছয়টি, দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কে একটি, রংপুর-বালিয়াডাঙ্গা মহাসড়কে একটি অস্থায়ী, বাংলাবান্ধা-পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কে একটি এবং বড়বাড়ী-বুড়িমারি মহাসড়কে নয়টি হাটবাজার রয়েছে।
মাদারীপুর রিজিয়ন : মাদারীপুর রিজিয়নে মোট ২৯টি হাটবাজার রয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী রয়েছে ২৭টি এবং অস্থায়ী আরও দুটি। হাটবাজারের মধ্যে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে ২টি, নড়াইল-যশোর আঞ্চলিক মহাসড়কে একটি, ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ও কুষ্টিয়া-দৌলতদিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের গোয়ালন্দ মোড় বাজার, ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ও কুষ্টিয়া-দৌলতদিয়া মহাসড়কের বসন্তপুর বাজার। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে আরও ৭টি স্থায়ী হাটবাজার রয়েছে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে চারটি স্থায়ী এবং একটি অস্থায়ী বাজার রয়েছে। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে ২টি, খুলনা-মোংলা মহাসড়কে ৬টি, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে ২টি এবং ঢাকা-গোপালগঞ্জ মহাসড়কে একটি বাজার রয়েছে।
সিলেট রিজিয়ন : সিলেট রিজিয়নে মহাসড়কে ৭৫টি হাটবাজারের মধ্যে স্থায়ী হাটবাজার রয়েছে ৬০টি, অস্থায়ী তিনটি এবং উচ্ছেদ হওয়া তালিকায় রয়েছে ১২টি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৩১টি, কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে পাঁচটি, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে ১১টি, জাফলং-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে সাতটি, ঢাকা-মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কে নয়টি এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে ছয়টি হাটবাজার রয়েছে।
সূত্র: যুগান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত