যে কয়েলে মশা মরে সেই কয়েলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাচ্চারা
উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে মশার কয়েল তৈরি করছে নামসর্বস্ব অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এসব কারখানার অনুমোদনও নেই। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় এমন কারখানার সংখ্যা অন্তত ৪০।
নীতিমালা অনুযায়ী, মশা মারার জন্য নয় বরং মশা তাড়াতে কয়েল উৎপাদন ও ব্যবহারের কথা। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে অবৈধ কয়েল প্রস্তুতকারকরা। উচ্চমাত্রার রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে নিমিষে মশা মরে যাওয়ায় অসচেতন ক্রেতা ওই কয়েল ব্যবহার করছেন। আর বেশি লাভের আশায় খুচরা বিক্রেতারাও এসব কয়েল দোকানে রাখছেন।
কিন্তু অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের বিষাক্ত কয়েল প্রস্তুত ও বাজারজাত বন্ধ করার ক্ষেত্রে দেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যদিও বিএসটিআই বলছে, তারা অভিযান চালালে ওই সব কারখানা মালিক কারখানা সরিয়ে নিয়ে যায়। তবে তিনজন মালিক দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, অবৈধ হলেও তারা প্রভাবশালী সবপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে কারখানা চালাচ্ছেন।
দেশে মশা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেছেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি অনিবন্ধিত মশার কয়েলে এগ্রিকালচারাল পেসটিসাইড-এপি (কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক) উচ্চমাত্রায় রয়েছে। এই কীটনাশক মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মশার কয়েলে পাবলিক হেলথ পেসটিসাইড (পিএইচপি) বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য সহনীয় কীটনাশক ব্যবহার করার কথা।’ তিনি বলেন, অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের যেহেতু জবাবদিহি নেই তাই তারা পিএইচপির কথা বলে এপি ব্যবহার করে। আমরা দীর্ঘদিন এসবের বিরুদ্ধে বলে আসছি। কিন্তু কাজ হয় না।’
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, যে কয়েলে মশা মরে সেই কয়েলে মানুষও অসুস্থ হবে, বিশেষ করে বাচ্চারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজধানীর চাঁদ উদ্যানের ডোবার ওপর গড়ে ওঠা একটি কয়েল কারখানার বিরুদ্ধে গত বছর অভিযান চালায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ভ্রাম্যমাণ আদালত। এই কারখানার তৈরি কয়েল চারটি নামে এখন বাজারে পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে লামিয়া নিমপাতা, লামিয়া হাই বুস্টার, লামিয়া জাম্বু ও লামিয়া লাল হিট।
এই কয়েল ব্যবহারের কারণে এক ব্যক্তির শিশুসন্তান ও অন্যজনের কবুতর মারা যাওয়ার অভিযোগ পেয়ে বিএসটিআই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় কারখানাটিকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও কারখানাসহ দুটি গোডাউন সিলগালা করে দেওয়া হয়।
গত সোমবার এই প্রতিবেদক চাঁদ উদ্যানে আগের কারখানায় গিয়ে দেখেছেন সেখানে শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় আছে। তবে ওই কার্যালয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, বিএসটিআইয়ের চোখ ফাঁকি দিতে কারখানাটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জে। এই গোপন ঠিকানা থেকে প্রতি রাতে পিকঅ্যাপ ভ্যানে করে কয়েল পাঠানো হয় ঢাকার চকবাজারে। এই চকবাজারেই রয়েছে অবৈধ কয়েল বাজারজাতকরণের শক্তিশালী চক্র। তারাই এসব ক্ষতিকারক কয়েল সারা দেশে দোকানে দোকানে সরবরাহ করে।
লামিয়া ব্র্যান্ডের কয়েল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন। তিনি স্বীকার করেছেন যে ১০ বছর আগেও ঢাকার মৌলভীবাজার ও চকবাজার এলাকায় ঠেলাগাড়ি চালাতে তিনি। মাথায় করে পণ্য পৌঁছে দিতেন দোকানে দোকানে।
শামসুদ্দীন জানিয়েছেন, চকবাজারে থাকতেই তিনি পরিচিত হন অবৈধ কয়েল তৈরি ও বাজারজাত করার চক্রের সঙ্গে। এরপর ২০১১ সালে চালু করেন কয়েল তৈরির কারখানা। বর্তমানে কয়েল ব্যবসা থেকে বছরে অন্তত ৫০ লাখ টাকা লাভ হয় তার।
এখন তার কারখানা কোথায় জানতে চাইলে দুই ধরনের তথ্য দেন শামসুদ্দীন। প্রথমে বলেন, ঢাকার কেরানীগঞ্জে। পরে বলেন, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। তিনি বলেন, ‘বেশি রাসায়নিক না দিলে মশা মরে না আর মশা না মরলে মানুষ কয়েল কেনে না।’
মশার কয়েলে কী মাত্রার রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে তার একটি মান ঠিক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির হিসাবে মশার কয়েলে সর্বোচ্চ দশমিক ৩ মাত্রার রাসায়নিক ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দেশের অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশের একটি কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশের বাজারের অখ্যাত ১৪টি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল পরীক্ষার জন্য ভারতে পাঠায়। এতে দেখা যায়, এসব কয়েলে মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ১৪ গুণ বেশি রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে ২০১৫ সালে, জাপানের সুমিতমো কেমিক্যালের কাছেও ২৪টি কয়েলের নমুনা পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। তাতেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হারে এবং আইন ভেঙে একাধিক রাসায়নিক ব্যবহারের চিত্র পাওয়া যায়। অধ্যাপক কবিরুল বাশারও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সার্টিফিকেশন মার্কস-সিএম) নুরুল আমিন বলেছেন, ঢাকা বিভাগে (ফরিদপুর ছাড়া) ৩৭টি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণ করতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। কিন্তু তারা ঠিকানা পরিবর্তন করে আবার একই অপকর্ম চালায়। ফলে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না।’
এই কর্মকর্তা জানান, রাসায়নিক পণ্য তৈরিতে বিএসটিআই থেকে অনুমোদন পাওয়ার আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে অনুমোদন পেতে হয়।
উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার একজন উপপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, কয়েল উৎপাদনের জন্য দেশে এখন ১৭টি রাসায়নিক পদার্থ আমদানি হয়। এগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী সর্বোচ্চ দশমিক ৩ মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
কিন্তু বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সুপার ডিসকভারি, মাছরাঙ্গা, সোনালী কিং, প্যাগোডা গোল্ড, তুলসী পাতা, সুপার ফিলিপস ডিআইএম জাম্বু, অ্যাটাং কিং সেইফ গার্ড, এক্সট্রা হাই পাওয়ার লিজার্ড মেগা, বস সুপার, টাটা হাই স্পিড, মেট্রো, সুপার জাদু, মাছরাঙ্গা কিং, সুপার সান পাওয়ার, এ-জেড মেঘনা, মারুফ পাওয়ার ম্যাজিক, পোলার, মাছরাঙ্গা মেঘাসহ বিভিন্ন নামে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক যুক্ত কয়েল উৎপাদন ও বিক্রি চলছে। এসব কয়েলের কারখানা রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ঢাকার সাভার, কামরাঙ্গীরচর, গাজীপুরের টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ রেফারেল ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল মেজারমেন্ট (বিআরআইসিএম) এর মহাপরিচালক মালা খান বলেন, ‘শুধু কয়েলই নয়, আমাদের কাছে যখন বিভিন্ন পণ্য আসে তখন পরীক্ষা করে দেখা যায়, ঘোষিত উপাদান ওই পণ্যে থাকে না। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে এসব আগে ধরতে হবে।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত