শায়খ আহমাদুল্লাহ’র চার উদ্যোগ
সারাদেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে এক হাজার মেট্রিক টন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। এর মাধ্যমে বানভাসি মানুষের জন্য প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষের মধ্যে এসব ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের বেশ কিছু জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে এ বছর। বন্যার এত ভয়ঙ্কর রূপ আগে কখনও দেখেনি ওইসব এলাকার মানুষ। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এবারের বন্যা। প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ছিল পানিবন্দি।
আশ্রয়হীন হয়েও সেদিকে খেয়াল ছিলো না বানভাসিদের। এক বেলা খাবারের আশায় ছুটোছুটি করছেন তারা সারাদিন। ত্রাণের জন্য চলছিল হাহাকার।
বন্যাদুর্গতদের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের অবদান এবার সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন তাদের মধ্যে অন্যতম। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় এ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির কাজের প্রশংসা করছেন সবাই। ব্যক্তিগত সহায়তার পাশাপাশি অনেক সংস্থা ও কোম্পানী আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাদের সহায়তা বানভাসিদের কাছে পাঠিয়েছেন।
বানভাসিদের মুখে খাবার তুলে দিতে ব্যাপক পরিমাণ ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে এ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। সঙ্গে ওষুধপত্র ও বিশুদ্ধ পানিও সরবরাহ করছেন তারা। বন্যায় আক্রান্ত শিশুদের খাদ্র-সামগ্রীও পাঠাচ্ছে এ ফাউন্ডেশন। এছাড়াও বন্যকবলিত অঞ্চলের গরু-ছাগলের জন্য খাবারও পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা।
ফাউন্ডেশনের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী ছাড়াও সেনাবাহিনীর ত্রাণ কার্যক্রমের সহায়তায়ও ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে ত্রাণের প্যাকেট। প্রতিটি প্যাকেটে থাকছে চাল, ডাল, চিড়া, খেজুর, সয়াবিন তেল, লবণ, হলুদ, মরিচ, ছাতু, গুঁড়ো দুধ, বিশুদ্ধ পানি, ভুসি, মোমবাতি, সাবান ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।
বন্যার পানি নেমে গেলে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে টিন ও প্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণ করে পুনর্বাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি। আর এসব কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ।
আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন মূলত একটি সরকার নিবন্ধিত সমাজসেবামূলক, অরাজনৈতিক ফাউন্ডেশন। ২০১৭ সালে শায়খ আহমাদুল্লাহ এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
ফাউন্ডেশনের কর্ণধার শায়খ আহমাদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, কয়েক মাস আগে প্রথম যখন সিলেট অঞ্চলে বন্যা শুরু হয়, তখনই আমাদের আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুকনো খাবারসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। কিছু দিনের মধ্যে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করি আমরা। কিন্তু আল্লাহর কী ইচ্ছা, পুনর্বাসন কার্যক্রম চলমান অবস্থায় নতুন করে আবার পানি বাড়তে শুরু করে।
তিনি বলেন, আগের চেয়ে অনেক ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবার। আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করে আবারও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শুরু করি। আমাদের দাতা-শুভানুধ্যায়ীরাও এগিয়ে আসেন। আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ওপর আস্থা রেখে তারা অনুদান পাঠাতে থাকেন। আমরা ৬০০ স্বেচ্ছাসেবীর সহযোগিতায় অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বন্যার্ত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে চলছি।
বন্যার্তদের পাশে চার স্তরে সহযোগীতা করার উদ্যোগ নিয়েছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের জন্য শুকনা ও সীমিত খাবার (চিড়া, খেজুর, অল্প পরিমাণ চাল ডাল ইত্যাদি। দীর্ঘ মেয়াদী খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য ১ বস্তা করে চাল। কুরবানি উপলক্ষ্যে গোশত বিতরণ ও পুনর্বাসন।
খাদ্য বিতরণ কার্যক্রমের পাশাপাশি পুনর্বাসনের কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। এ খাতে ৫ কোটি টাকা ব্যায়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ধরণের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংগঠনটি জড়িত। এরমধ্যে দ্বীনী শিক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বীকরণ প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্প চলমান রয়েছে।
ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্পর্কে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, আর্তমানবতার সেবা, সমাজ-সংস্কার, মহোত্তম নীতিচেতনার সঞ্চার, পরিচ্ছন্ন মানসিকতা গঠনে নিরন্তর নানা কর্মসূচি পালন, সর্বোপরি একটি আদর্শ কল্যাণসমাজ বিনির্মাণে যথাশক্তি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। শিক্ষা, সেবা ও দা‘ওয়াহ- এ তিনভাবে আমাদের ধারাবাহিক কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণে ও দারিদ্র্য বিমোচনে হস্তশিল্প, যন্ত্রশিল্প, কারিগরি, খামার ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীলতার জন্যও অর্থ সহায়তা প্রদান করছি আমরা। এ পর্যন্ত স্বাবলম্বীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে
আমরা ১৩শ পরিবারকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি— শুধু প্রশিক্ষণ, অর্থ ও উপকরণ-সহায়তা প্রদান অনেকের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বিতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য আমরা ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রশিক্ষিত, আর্থিক ও উপকরণ-সহায়তাপ্রাপ্তদের নিয়মিত তত্ত্বাবধান করি, খোঁজ-খবর রাখি এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকি। এভাবে আমরা নৈতিকতা সম্পন্ন সুদক্ষ কর্মজীবী জনগোষ্ঠী তৈরিতে ভূমিকা রাখি।
অনেক অভাবী মানুষ বছরে কেবল কুরবানির ঈদেই গরু বা ছাগলের গোশতের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পান। তাঁদের বিষয়টি বিবেচনা করে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন প্রতি বছর আয়োজন করে ‘সবার জন্য কুরবানি’।
গত বছর ৬৪০ জনের পক্ষ থেকে ৫১টি জেলায় ৪৮টি গরু ও ৩০৪টি ছাগল কুরবানী করে ৮ হাজার দুস্থ পরিবারের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। এ বছর এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন তারা।
এ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত দেশের ৫১টি জেলায় ৬৭৬টি গরু ও ১৬ হাজার ৪৯৭টি ছাগল কুরবানি করে গরিব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এবছর ১০০টি গরু কুরবানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, দুর্যোগকালে বিত্তবান মানুষদের উচিত সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতার হাত বাড়ানো। যার পক্ষে যেভাবে সম্ভব, কাজ করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তারা, যারা মানুষের কল্যাণে নিজেকে বেশি নিবেদিত রাখে।’ মানবতার কল্যাণে বেরিয়ে আসার সুবর্ণ সময় এটি। এ ধরনের ছোটখাটো আমল কোনো ঈমানদারের জান্নাত নিশ্চিত করে দিতে পারে। বেঁচে থাকলে টাকা উপার্জনের সুযোগ বহু আসবে। কিন্তু জান্নাত এত কাছে সব সময় আসে না। তাই মানবসেবায় আমাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের স্বাক্ষর রাখতে হবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত