শিক্ষায় বরাদ্দ তলানিতে, কোনো দিকনির্দেশনাও নেই
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে টাকার অংকে বরাদ্দ বাড়লেও আকারে কমেছে। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নে এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারিগরি শিক্ষার প্রসারের দর্শন দেখা গেলেও বরাদ্দে এর প্রতিফলন নেই। করোনায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনাও আসেনি এ বাজেটে। বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট উত্থাপনের পর রাতে শিক্ষাবিদরা এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এবার ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সেই হিসেবে মোট বাজেটের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শিক্ষাখাতে।
জিডিপি আড়াই শতাংশের নিচেই রয়েছে, যা চলতি বছরের জন্য করা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘টাকার অংকে বাড়লেও বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। শিক্ষাখাতে সিঙ্গেল সেক্টরে নিয়ে আসার প্রত্যাশা থাকলেও সেটি পূরণ হয়নি। তাতে করে মনে হয় বাজেটে শিক্ষায় গুরুত্ব কম।’
এবারের বাজেট সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্য, ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্যমান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটি চ্যালেঞ্জের বাজেট দেওয়া হয়েছে। অনেক ভালো নির্দেশনা, দর্শন ও বৈষম্য দূরীকরণের কথাও এসেছে। বিশেষ ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিষয় রয়েছে। তবে কিছু বিষয় অনুপস্থিতও রয়েছে।’
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘২০২০-২১ সালে অনেক শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে একটি বিশেষ নীতিমালার আওতায় উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা জরুরি হলেও সেটি হয়নি। করোনাকালে শিক্ষায়, আর্থসামাজিক যে বৈষম্য হয়েছে, তা দূরীকরণে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হলেও সেই নির্দেশনা সুনির্দিষ্ট না। মোবাইল-ল্যাপটপের দাম বাড়ালেও ইন্টারনেটের দাম সহজলভ্য না করলে কাজে আসবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারিকুলাম সহজীকরণের কথা বলা হচ্ছে, সেই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বারবার বলা হলেও বাজেট বাড়ানোর বিষয়টি দেখা যায়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বাজেটে টাকার অংকে বাড়লেও কারিগারি শিক্ষায় তেমন বাজেট বাড়েনি। আমরা আশা করেছিলাম, আগামী বাজেটে শিশুদের মিড ডে মিলটা বাস্তবায়ন হবে। সেটি না করে পুরোনো দিনের বিস্কুট বিতরণের দিকে ফিরে যাচ্ছে। দেশে অনেক বড় বড় মেগা প্রকল্প আছে, অবকাঠামো আছে, শিক্ষায় তেমন কিছু দেখিনি।’
বাজেটে যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটা যথাযথ ব্যয় করা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় করতে পারলে সুফল আসবে মন্তব্য করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেই অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে হয়তো অনেকখানি লক্ষ্য অর্জন হবে। বরাদ্দ বাড়ালেই তো হবে না, সেটি কোথায় গেলো, কীভাবে ব্যবহার হলো সেটি দেখার আহ্বান জানাবো।’
শিক্ষাবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার দুটি তত্ত্ব আছে, সেটি হলো পেট আর পকেট যদি ভালো থাকে, তবে বলবো বাজেট ভালো। মাথাপিছু আয় আর জাতীয় গড় পদ্ধতি এগুলো পুঁজিবাদী পদ্ধতি। আমি এগুলোতে বিশ্বাসী না। শিক্ষাখাতে সারা পৃথিবীতে ছয় শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হলেও আমাদের দেশে তিন শতাংশের বেশি বাড়ে না। বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে এটি পর্যাপ্ত নয়, এটি আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’ দেশ উন্নয়নের জন্য এ খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তারিক আহসান বলেন, ‘শিক্ষাখাতে আড়াই শতাংশের মতো জাতীয় বাজেটের জিডিপি গড়, বর্তমানে যা আছে আমাদের তার দ্বিগুণ দরকার। তবে আমি আশাবাদী যে, বর্তমানে কারিকুলাম যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট ইতিবাচক। অদূর ভবিষ্যতে আমরা হয়তো বাজেটে একটি ইন্ডিকেটর (মাপকাঠি) পাবো। বর্তমানে যেটি ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি দিয়ে তা বাস্তবায়নে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হবে।’
আগামী বছরের প্রস্তাবিত শিক্ষাখাতের বরাদ্দ দিয়ে অতিমারিতে সাধিত ক্ষতি কতটা কাটানো যাবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা খাতে আমরা বাজেটের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। এটাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সরকারের নীতিতে সেটিও আছে বলে জেনেছি।’
শিক্ষাখাতে বাজেটের ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন অধ্যাপক তারিক আহসান।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত