শেয়ার বাজার থেকে হঠাৎ উধাও ২১ হাজার কোটি টাকা
আবারও বিনিয়োগকারীদের মাঝে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ এই বাজার থেকে এখন বের হয়ে যেতে চাচ্ছেন। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দেউলিয়া ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট বাড়তে থাকে।
সম্প্রতি দেশে ডলার সংকট তথা মুদ্রাবাজার ও পণ্যবাজারের অস্থিরতার প্রভাবও পড়েছে শেয়ার বাজারে। এছাড়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ধরা পড়ার পর পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গত এক সপ্তাহে শেয়ার বাজার থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস সোমবার (১৬ মে) ভয়াবহ দরপতন হয় দেশের পুঁজিবাজারে। এদিন দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমে ১৩৪ পয়েন্ট। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমে ৩৮৪ পয়েন্ট। এই দরপতনের মধ্যে দিয়ে দুই মাসের আগের জায়গায় ফিরে গেছে পুঁজিবাজার। এভাবে গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া চার কার্যদিবসের প্রতিদিনই দরপতনের মধ্য দিয়ে পার করেছে দেশের শেয়ার বাজার।
যে কারণে অস্থিরতা
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ধরা পড়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অপরদিকে পণ্যবাজারের অস্থিরতা ছড়িয়েছে শেয়ার বাজারে। বিশেষ করে যারা বাড়তি আয়ের আশায় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে থাকেন, তারা বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কারণ, জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ সামাল দিতেই তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও রয়েছেন অর্থের সংকটে। মূলত, ব্যাংকগুলো এখন ডলারের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুদ্রাবাজার সামাল দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত আছে।
প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে ডলার কিনছে। অপরদিকে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। এছাড়া জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বাজারের ওপর আস্থা হারিয়েছেন, যার ফলে বাজারে বড় পতন দেখা দিয়েছে।
সাধারণত, রীতি অনুযায়ী বৈশ্বিক বা অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কোনও সংকট দেখা দিলে বা সংকটের আভাস পেলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায়।
শেয়ার বাজার বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ভয় থেকে বিক্রি-জনিত পতনের কবলে পড়েছে শেয়ার বাজার।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) বাজারে দর পতন ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি।
আইসিবিতে রাখা ব্যাংক ও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদপূর্তি হয়ে যাওয়া আমানতের আসল অর্থ যাতে এখনই ফেরত না দিয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
২১ হাজার কোটি টাকা হাওয়া
গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৫ লাখ ৩১ হাজার ১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ২১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।
শুধু মূলধন কমাই নয়, সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে গত সপ্তাহে। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণও। সপ্তাহজুড়ে ডিএসই-তে লেনদেনে অংশ নেওয়া মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়লেও দাম কমেছে ৩৬০টির। আর ৬টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৩০৭ দশমিক ২২ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমেছিল ৯০ দশমিক ২০ পয়েন্ট। তার আগের সপ্তাহে কমেছিল ৬ দশমিক ৭০ পয়েন্ট। অর্থাৎ তিন সপ্তাহের টানা পতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক হারিয়েছে ৪০৩ পয়েন্ট।
বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচকেরও টানা তিন সপ্তাহ পতন হয়েছে। গত সপ্তাহজুড়ে এই সূচকটি কমেছে ৯০ দশমিক ২৪ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমেছিল ৫৩ দশমিক ৮৫ পয়েন্ট। তার আগের সপ্তাহে কমেছিল ১৭ দশমিক ৩১ পয়েন্ট। অর্থাৎ তিন সপ্তাহের টানা পতনে ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত সূচকটি কমেছে ১৬১ পয়েন্ট।
এছাড়া ইসলামি শরিয়াহ’র ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ সূচকও টানা তিন সপ্তাহ কমেছে। গত সপ্তাহে এই সূচকটি কমেছে ৪৯ দশমিক ১৩ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমেছিল ১৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট। তার আগের সপ্তাহে কমেছিল ১৭ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট। অর্থাৎ তিন সপ্তাহের পতনে এই সূচকটি কমেছে ৮১ পয়েন্ট।
বাজারের তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসই-তে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৮০৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৭৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন কমেছে ২৭০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ২৩৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এই হিসাবে মোট লেনদেন কমেছে ২ হাজার ১৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা।
গত সপ্তাহে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সব চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২০৩ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শাইনপুকুর সিরামিকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৫৯ কোটি ৪৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত