সচিব, যুগ্মসচিব ও কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে যা হচ্ছে
প্রশাসনে উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) একাধিক বৈঠকও করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসের মধ্যে পদোন্নতি সম্পন্ন হতে পারে।
এ অবস্থায় যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি নিশ্চিতে আট উপসচিবের নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্যাডে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছেন এক সিনিয়র মন্ত্রী। অপর মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব করার জন্য নিজের প্যাডে চাহিদাপত্র দিয়েছেন।
বর্তমান জাতীয় সংসদের এক সদস্য এক কর্মকর্তাকে সচিব পদে পদোন্নতির জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে চাহিদাপত্র দিয়েছেন। এ ধরনের আরও অনেক ঘটনা আছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে তারা এমন সুপারিশ করতে পারেন না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আইন তৈরির কারিগররাই ভাঙছেন আইন। চাহিদাপত্র দিয়ে
মন্ত্রীরা শপথভঙ্গ করেছেন। শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা পদোন্নতি-পদায়নের জন্য মন্ত্রীদের দারস্থ হতে পারেন না। এভাবে পদোন্নতির জন্য মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে তারা চাকরি বিধিমালা লংঘন করেছেন। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, যে মন্ত্রী কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য চিঠি দিয়ে তদবির করেছেন তাদের মন্ত্রিত্ব থাকা উচিত নয়। একই সঙ্গে যেসব অফিসার তদবির করিয়েছেন তাদেরও চাকরি থাকা উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীরা শপথ নিয়ে এমন কাজ করতে পারেন না। এটা শপথের সুস্পষ্ট লংঘন।’
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট আরিফ খান বলেন, সংবিধানকে সমুন্নত রাখা মন্ত্রীদের অন্যতম দায়িত্ব। মন্ত্রীদের কাজই যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে এক সময় সরকারি কর্মচারীরাই তাদের নেতৃত্ব মানতে চাইবেন না। কারণ সরকারি কর্মচারীদের কোনো শপথ নেই।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শপথ নিয়ে থাকেন। তাদের শপথের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে, ‘আমি ভীত বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, মন্ত্রীদের শপথে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করার কথা বলা আছে। অথচ মন্ত্রী গুটিকয়েক কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করেছেন। প্রথমত এটা আইন অনুযায়ী আচরণ নয়। কারণ পদোন্নতির জন্য আলাদা আইন বিধিবিধান আছে। সে অনুযায়ী সবাই পদোন্নতি পাচ্ছেন। সেখানে গুটিকয়েক কর্মকর্তার জন্য যদি কোনো মন্ত্রী সুপারিশ করেন সেটা কোনোভাবেই সবার জন্য সমান আচরণের মধ্যে পড়ে না।
তারা বলেন, মন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্যরা আইন তৈরির কারিগর। এক্ষেত্রে কারিগরই আইন ভাঙছেন। একইভাবে যেসব কর্মকর্তা মন্ত্রীর সুপারিশ আনতে গেছেন তিনিও বিধি ভেঙেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঊর্ধ্বতনের কাছে দেখে দেখে অধস্তনরা সাহসী হয়ে উঠেছে। যে কারণে তারা পদোন্নতির জন্য মন্ত্রীর সুপারিশ আনার সাহস দেখাচ্ছেন।
শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তদবির করানো গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য। এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি-২০তে বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির দারস্থ হতে পারবেন না।’
অথচ বর্তমান সংসদের একজন সদস্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে চাহিদাপত্র দিয়েছেন ১০ম ব্যাচের এক কর্মকর্তাকে সচিব পদোন্নতি দেওয়ার জন্য। এমন একজনের পদোন্নতির তদবির করা হয়েছে, যিনি পূর্ণ মেয়াদে ডিসির দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়ার মতে, অনেক অফিসার আছেন যারা নিজেদের পক্ষে তদবির করান। তদবির করানোকে তাদের বড় অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পদোন্নতি তো নয়ই, বরং তাদের বিরুদ্ধে বিধিমালা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তাহলে কেউই এ ধরনের কাজ করার সাহস পাবে না। তিনি বলেন, মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে এমন উদ্যোগ নৈতিকতাবিরোধী।
চাকরিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর বিষয়ে আচরণবিধি-৩০ এ বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী তার চাকুরি সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব খাটাতে পারবে না।’
অথচ পদোন্নতির তদবিরের জন্য করা আবেদনের মধ্যে দৈনিক পত্রিকার হাতে থাকা একাধিক আবেদনে তাদের ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এমনকি পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ইতিহাস তুলে ধরেছেন অনেকে।
বিধি লংঘনের শাস্তি হিসেবে বিধি-৩২ এ বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী এই বিধিমালার কোনো বিধান লংঘন করলে অসদাচরণের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দায়ী হবেন।’ আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এই দায় নির্ধারণ করার কথা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের। অথচ তাদের কাছেই চিঠি যাচ্ছে। তারা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তো নিচ্ছেন না, এমনটি সামগ্রিকভাবে কোনো অফিস আদেশ বা পরিপত্র জারি করে এসব বিষয়ে বিধিমালাভঙ্গের বিষয়টি স্মরণও করিয়ে দিচ্ছেন না।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য জানার চেষ্টা করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, যারা নিয়ম পালন করার কথা, মেনে চলার কথা তারাই নিয়ম ভাঙছেন।
এ কর্মকর্তা বলেন, আগের দিনে মন্ত্রীদের সামনে যাওয়ার সময় কর্মকর্তারা প্রস্তুতি নিয়ে যেতেন। এখন তেমন কিছু দেখা যায় না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উচিত এসব বিষয়ে যথাযথভাবে সতর্ক করা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সোলতান আহমদের কাছে মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনাদের জায়গা থেকে আইন-বিধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। কিন্তু আমার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই।’
সূত্র: যুগান্তর
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত