সরকারি চাকরির প্রশ্ন ফাঁস করে কোটিপতি, শেষ রক্ষা হলো না
উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরে তাদের বাড়ি। দুই জনের একজন ইউনানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আরেকজন আদালতের কর্মচারী। কিন্তু তারা দুই জনই কোটিপতি। বৈধ কোনও উপায়ে কোটিপতি হননি তারা। ব্যাংক নিয়োগসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি টাকা কামিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাদের।
সোমবার (১৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। গ্রেফতারকৃতরা হলো জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ ও রবিউল ইসলাম রবি।
দুই জনের মধ্যে রবিকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ। জাহিদকে মঙ্গলবার আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত তাকে কারাগরে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
গত ৬ নভেম্বর থকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রথমে সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহামান মিলন এবং রাইসুল ইসলাম স্বপন। এর পরদিন গ্রেফতার করা হয় সোহেল রানা, এমদাদুল হক খোকন ও এবিএম জাহিদকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাঁচ জনই বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। সর্বশেষে এই চক্রের অন্যতম দুই সদস্য জাহিদ ও রবিকে গ্রেফতার কর হলো।
গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বলেন,আগে গ্রেফতার হওয়া সোহেল রানার কাছ থেকে জাহিদ ও রবির সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে জাহিদ ও রবিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুজনেই সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রের হয়ে কাজ করার কথা স্বীকার করেছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাহিদ ও রবি জানিয়েছে,গ্রেফতারকৃত জাহিদ ও রবি রংপুরের কেরাণীরহাট এলাকায় বাস করেন। মিজু নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তাদের পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে গত কয়েক বছর ধরে তারা বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে বিক্রি করে আসছিল।
সবশেষ সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য তারা মিজুর সঙ্গে ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় প্রশ্ন কেনার চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী মিজু পরীক্ষার আগে তাদের এক সেট প্রশ্ন দেয়। সেই প্রশ্নপত্র তারা বিভিন্ন চাকরী প্রার্থীদের কাছে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকায় জনপ্রতি বিক্রি করে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান,গ্রেফতারকৃত জাহিদ ও রবি প্রশ্ন ফাঁস করে গত কয়েক বছরে কোটিপতি হয়েছেন। আদালতের সাধারণ একজন কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন জাহিদ। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস করে অবৈধ উপায়ে আয় করা অর্থ দিয়ে রংপুরের কেরানীহাটের কামদেবপুর এলাকায় অনেক জমি ক্রয় করেছেন। এছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় জাহিদ বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করেছেন।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান,গ্রেফতারকৃত রবি রংপুরে ছোট্ট একটি ইউনানী ওষুধের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এই ব্যবসার আড়ালে তিনি বিভিন্ন চাকরীর পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করতেন। তিনিও জাহিদের মতো অবৈধভাবে আয়কৃত অর্থ দিয়ে গত কয়েক বছরে জমি জায়গাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করেছেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়,সর্বশেষ সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি ও পরীক্ষা নেওয়ার কাজটি টেন্ডারের মাধ্যমে পেয়েছিল আহছান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধানে তৈরিকৃত প্রশ্ন ছাপাখানা থেকেই ফাঁস হতো। এতে মোক্তারুজ্জামান রয়েলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন কর্মচারী জড়িত ছিল। এছাড়া প্রশ্ন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধরের নামও এসেছে। তিনি প্রতিবার প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার পর দুই সেট প্রশ্ন নিজের ব্যাগে করে নিয়ে যেতেন। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান,আহছান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধানে তৈরিকৃত প্রশ্ন কয়েকজনের মাধ্যমে ফাঁস হতো। এর মধ্যে একটি লাইন তারা শনাক্ত করে ফেলেন। সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া জাহিদ ও রবি জিজ্ঞাসাবাদে যে মিজু নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রশ্ন পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সেই মিজুকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মিজুকে গ্রেফতার করা হলে মিজু কার কাছ থেকে প্রশ্ন নিতেন সেটি জানা যাবে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত