সরকারি নিলামের পণ্য কম দামে কিনবেন যেভাবে
বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে সরকারি দপ্তর থেকে মালামাল অকশন বা নিলামে তোলা হয়ে থাকে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে জমি, বাড়ি, গাড়ি থেকে শুরু করে তেল, পেঁয়াজ, রসুনের মত কাঁচা পণ্য, এমনকি সুতাও। বাজারে প্রচলিত দামের তুলনায় সরকারি নিলামে কম মূল্যে এসব পণ্য কেনা যায়। অনেক পণ্যের প্রতি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ থাকে, যেমন কাঁচা পণ্য, তেল, গার্মেন্টস আইটেম ইত্যাদি।
তবে সরকারি নিলাম হলে গাড়ি ও মোটরবাইক কেনার প্রতি সাধারণ ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি থাকে। সাধারণ ক্রেতারা নিজেরাই সরাসরি এসব পণ্য কেনার জন্য নিলামে অংশ নিতে পারেন। সাধারণ ক্রেতারা কীভাবে সরকারি নিলামে অংশ নিয়ে পণ্য বা মালামাল কিনতে পারেন, এখানে তারই বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে।
নিলাম কেন হয়?
কোন কারণে পণ্য জব্দ করা হলে, মালিক না পাওয়া গেলে, পণ্য বাবদ সরকারের প্রাপ্য শুল্ক অপরিশোধিত থাকলে বা দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকলে সেগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে সরকার।
যেমন ঋণ পরিশোধে অপারগতার কারণে বাড়ি বা জমি, কারখানা নিলামে তোলা হয়। আবার শুল্ক বকেয়া থাকলে, দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকলে গাড়ি, মোটরবাইক, অন্যান্য জিনিসপত্র নিলামে তোলে কাস্টমস।
চলতি মাসেই বেশ কিছু গাড়ি নিলামের মাধ্যমে বিক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে মোংলা বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরেও শতাধিক দামী গাড়ির নিলাম হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর এসব নিলাম আহ্বান করে থাকে।
চট্টগ্রাম, মোংলা, বেনাপোল বা কমলাপুরের রেলওয়ে গুদামে যখন কোন পণ্য নিলামে তোলা হয়, তখন দরপত্রে অংশগ্রহণ করে সর্বোচ্চ দর দিয়েই সেটার মালিক হওয়া সম্ভব।
তবে জমি, বাড়ি বা কারখানা যখন নিলামে তোলা হয়, সাধারণত আদালতের আদেশের ভিত্তিতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগুলো নিলামে তোলে, তখন নিলামে অংশ নিতে কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
নিলামে কারা অংশ নিতে পারেন?
যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিলামে অংশ নিতে পারে। মোংলা কাস্টম হাউজের রাজস্ব কর্মকর্তা আবু বাসার সিদ্দিক বলছেন, ”আমাদের নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়াটা খুব সহজ। যেকোনো ব্যক্তি এতে অংশ নিতে পারেন।”
নিলামে অংশ নেয়ার জন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভেদে কাগজপত্রের কিছু চাহিদা রয়েছে। ঢাকার শাহজাদপুরের একজন বাসিন্দা নেওয়াজ চৌধুরী কয়েক বছর আগে মোংলা কাস্টমসের একটি নিলামে অংশ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন।
তিনি বলছেন, ”নিলামে কিছু কিনতে হলে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী গাড়ি বা পণ্য নিলামে তোলা হলে আগে সেটা নিজে দেখে যাচাই করে দেখা উচিত। তারপর নিলামে নিলামে অংশ নেয়া উচিত।”
তিনি বলছেন, বাজার মূল্যের তুলনায় তিনি নিলাম থেকে বেশ কম মূল্যে তার পছন্দের গাড়িটি কিনতে পেরেছেন। নিলামকারী প্রতিষ্ঠান যদি তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের দাম না পায়, তাহলে পরবর্তীতে আরও অন্তত দুইবার নিলাম ডাকতে পারে। তৃতীয়বারে অবশ্য যে দাম পাওয়া যায়, সেই দামেই পণ্য ছেড়ে দেয়া হয়।
কীভাবে নিলামে অংশ নেয়া যায়?
সরকারি নিলামে অংশ নিতে হলে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। নেওয়াজ চৌধুরী বলছেন, দরপত্র কেনার আগে নির্ধারিত নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্যের বিবরণ সম্বলিত একটি ক্যাটালগ (লট ভিত্তিক পণ্যের তালিকা) কেনা উচিৎ। সেখানে কোন কোন পণ্য নিলামে তোলা হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ, কাস্টমস কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। সেখান থেকে প্রথমে নিজের পছন্দের পণ্যটি বাছাই করতে হবে।
নিলাম বিজ্ঞপ্তিতেই এই নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেয়া থাকে।
এরকম একটি নিলামকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল-আমিন ট্রেডার্সের কর্মকর্তা কাজী আব্দুল্লাহ বিন শাহরিয়ার বলছেন, ”কাস্টমস বা বন্দর কর্তৃপক্ষ তো নিলাম করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের কাজ হলো সেটি বাস্তবায়নের কাজ করা। অর্থাৎ নিলাম ক্যাটালগ তৈরি, প্রাথমিক তথ্য দেয়া, নিলামের জিনিসপত্র কন্টেইনার থেকে বের করে রেডি করা ইত্যাদি সব কিছু আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
ক্যাটালগ অনুযায়ী পছন্দের লট অনুযায়ী প্রতিটি লটের জন্য একটি করে দরপত্র কিনতে হবে আগ্রহী ক্রেতাদের। যেমন কেউ যদি তিনটা গাড়ি কিনতে চান, তাকে তিনটা দরপত্র কিনতে হবে। নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই শিডিউল বা দরপত্র কেনা যাবে।
রাজস্ব কর্মকর্তা আবু বাসার সিদ্দিক বলছেন, ”যখন কেউ ব্যক্তিগতভাবে নিলামে অংশ নিতে চাইবেন, পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেখার পরে নিলামে অংশ নেয়ার জন্য তাকে প্রথম দরপত্র কিনতে হবে। তারপর সেটি পূরণ করে জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, আয়কর সনদ বা টিআইএনের কপি, উদ্ধৃত দরের ১০ শতাংশ হারে পে অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফটসহ জমা দিতে হবে। নিলামে যে তারিখ নির্ধারিত থাকবে, তার মধ্যেই অবশ্যই সেটি জমা দিতে হবে।”
কখনো কখনো নিলামের ক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য থাকে। এই ধরণের পণ্য কিনতে হলে পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি ছাড়পত্র আনতে হয়। যেমন বাংলাদেশে সাধারণত জাপান থেকে রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানি করা হয়। কিন্তু জার্মানি থেকে কোন গাড়ি আমদানি করা হলে সেটি ছাড়াতে এরকম ছাড়পত্রের দরকার হতে পারে।
একজন ব্যক্তি নিজেই সরাসরি এরকম নিলামে অংশ নিতে পারেন। আবার তার প্রতিনিধি হিসাবে কোন সিএন্ডএফ এজেন্টকেও এজন্য নিযুক্ত করতে পারেন।
নিলামের ক্ষেত্রে যত টাকা প্রস্তাব করা উচিৎ
নিলামে ক্রেতা নিজে পণ্যের মূল্য প্রস্তাব করে থাকেন। ফলে এই মূল্য সুচিন্তিত না হলে বেশি দিয়ে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার খুব কম হলে পণ্যটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
আবু বাসার সিদ্দিক বলছেন, ”প্রতিটি পণ্যের জন্য আমরা যে নির্ধারিত মূল্য ঠিক করেছি, তার ৬০ শতাংশ দাম পেলেই ওই পণ্যটি ছেড়ে দেয়া হয়। তবে এর কম হলে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার নিলাম ডাকতে হতে পারে।”
অর্থাৎ ১০০ টাকা মূল্যমানের একটি পণ্যের জন্য নিলামে যদি ৬০ টাকা প্রস্তাব করা হয়, তাহলে সেটি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সেই পণ্যের যদি বাজারে চাহিদা বেশি থাকে, তাহলে দাম আরও বেশি উঠতে পারে।
নিলামে পণ্য ক্রেতা নেওয়াজ মওলা বলছেন, ”পণ্যটি মডেল অনুযায়ী প্রস্তাব করার আগে সেটির বাজার মূল্য কত আছে, সেটির বাস্তব অবস্থা কী, দীর্ঘদিন পরে থাকার কারণে তার পেছনে নতুন করে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে কিনা, সেটি আগে নিলামে উঠে থাকলে তখন কত টাকা পর্যন্ত দর উঠেছিল, ইত্যাদি খোঁজখবর নিয়ে মূল্য প্রস্তাব করা উচিৎ।”
নিলামে বিজয়ী হলে যা করতে হয়
নিলামে যিনি সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হন, তিনি বা তাদের অনুকূলে বিক্রয় আদেশ জারি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যেমন: চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরের নিলামে বিজয়ীদের ক্ষেত্রে আদেশ জারি করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
পণ্য নিয়ে কোন শর্ত বা মামলা থাকলে বলা হয় যে, সেসব শর্ত পূরণের পর এই আদেশ কার্যকর হবে। বিক্রয় আদেশে নিলামে বিজয়ী ব্যক্তিদের বাকি মূল্য পরিশোধ করে পণ্য বুঝে নেয়ার সময় বেঁধে দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বাকি মূল্য ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করে ওই কর্তৃপক্ষ বরাবর পণ্য বুঝিয়ে দেয়ার আবেদন করতে হবে।
রাজস্ব কর্মকর্তা আবু বাসার সিদ্দিক বলছেন, আবেদন পাওয়ার পর আমাদের অফিসিয়াল কিছু কাজ থাকে। কিন্তু সেগুলো একদিনেই হয়ে যায়। ফলে সকালে কেউ আবেদন করলে বিকালেই পণ্য বুঝে নিয়ে যেতে পারেন।
”আবেদনে বলতে পারেন যে, অমুক তারিখের নিলাম সেলে এত নম্বর লটে আমি এই পণ্য পেয়েছি। আমাকে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত করা হয়েছে এবং আমি বিক্রয় আদেশ পেয়েছি। তাই পণ্যটা আমার অনুকূলে খালাস করার অনুরোধ করছি, এইভাবে আবেদনটা করা যেতে পারে,” বলছেন মি. সিদ্দিক। এরপর তিনি বন্দর থেকে পণ্য ছাড়িয়ে নেবেন।
গাড়ি বা মোটরবাইকের ক্ষেত্রে পণ্য ছাড়িয়ে নেয়ার পর নিলামের বিজ্ঞপ্তি, বিক্রয় আদেশ, পণ্য খালাস আদেশ ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে। বাহন রেজিস্ট্রেশনের সময় এগুলোর কপি জমা দিতে হয়।
পাতানো নিলামের অভিযোগ
অনেকে অভিযোগ করেন, নিলামে অংশ নিলেও পণ্য পাওয়া যায় না। কারণ কে পাবে, তা আগে থেকে ঠিক করা থাকে। তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলছেন, ”এটা একেবারেই ঠিক নয়। সেরকম যদি হতো, তাহলে তো নিলাম ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়ত”।
এই অভিযোগ তারা বলে যারা পায় না বা বোঝে না, বলছিলেন মি. সিদ্দিক। তিনি উল্লেখ করছেন, ভবিষ্যতে নিলাম যাতে অনলাইনে করা যায়, সেরকম ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
নিলামে পণ্য না পেলে জমা টাকা ফেরতের ব্যবস্থা কী?
নিলাম হওয়ার পর যখন বিক্রয় আদেশ জারি করা হবে, সেদিন থেকেই বাকি আগ্রহী ক্রেতারা তাদের জমা দেয়া টাকা তুলে নিতে পারবেন। তাদের জমা দেয়া পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট তাদের ফেরৎ দেয়া হবে। আবার নিলামে বিজয়ী হওয়ার পরেও যদি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে কেউ মালামাল খালাস করে না নেন, তাহলে তার জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হতে পারে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত