সারা বিশ্বে কমলেও সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষ
বাংলাদেশ যেসব খাদ্যপণ্য আমদানি করে এর বেশিরভাগেরই দাম সম্প্রতি বিশ্ববাজারে কমেছে। কিন্তু দেশের ক্রেতারা সেই কম দামের সুফল পাচ্ছেন না। দেশে মার্কিন ডলারের উচ্চমূল্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের বাড়তি মুনাফাও এর কারণ।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে এমন মতামত দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী এবং কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এর সুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমদানি করা পণ্যের দাম পরিশোধে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় মার্কিন ডলার। এর দাম নিয়মিত বেড়ে চলায় ভোক্তারা পণ্যের দাম কমার সুফল পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি থাকার কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা করার কারণে দাম কমছে না।
গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে চালের দাম কেজিতে ৫০ পয়সা বাড়ার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৪ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছেন। যদিও বাজারে চালের দাম বেড়েছে আরও বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে এ পর্যন্ত মোটা চালের দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর আগে দেশের বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪২ থেকে ৪৪ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন কিনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। একই অবস্থা সরু চালের বাজারে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় ট্যারিফ কমিশন বেশ কিছু পণ্যের বাজারদর নির্ধারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে .সুপারিশ করে। এ ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় উৎপাদন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি, স্থানীয় বাজারদর ও সরবরাহ পদ্ধতি বিবেচনার মাধ্যমে সামগ্রিক পর্যালোচনা করে। সম্প্রতি চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজের বাজারদর নির্ধারণ বিষয়ে একটি সুপারিশ প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সংস্থাটি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরের ব্যবধানে স্থানীয় বাজারে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। চিনিতে বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। দুটি পণ্যই আমদানিনির্ভর। অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে দেশে পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ডালের বেলায় কোনো ধরনের মূল্য সংযোজনের দরকার পড়ে না। খোলা অবস্থায়ই বিক্রি হয় বেশিরভাগ ডাল। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম মাত্র শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। আর মসুর ডালের দাম কমেছে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। কিন্তু পণ্য দুটির দাম স্থানীয় বাজারে কমার পরিবর্তে বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ, ডলারের দাম বৃদ্ধি। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফাও দায়ী।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খোলাবাজারে মসুর ডাল মানভেদে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে। আর চিনি পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৮ টাকা কেজি দরে। কিন্তু স্থানীয় বাজারজাতকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মসুর ডাল ও চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে। প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ৯৫ টাকা আর প্যাকেটজাত ডাল প্রতি কেজি ১৯০ টাকায় বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো। এতে অত্যাবশ্যক বিপণন পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ এর ব্যত্যয় ঘটছে। একদিকে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা করছেন। এ অবস্থায় প্যাকেটজাত ডাল ও চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী নির্ধারণের সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। একই সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা সমকালকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অনেক পণ্যের দাম কমছে। সরকারের তদারকির অভাব এবং ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতার কারণে এর সুফল দেশের ভোক্তারা পাচ্ছেন না। কিছু পণ্যের দামের ক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার নেই। তবে কিছু পণ্যের বেলায় সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে। এ জন্য বাজারে সঠিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। বাজারে ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে মনিটর করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের পণ্যের দাম নিয়ে তৈরি করা সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গেল জুলাই মাসে বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমেছে। আগের মাস জুনের তুলনায় গত মাসে জ্বালানি, কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, ধাতব পণ্যসহ প্রায় সব ক্যাটাগরিতে গড় মূল্য কমেছে। খাদ্যপণ্যের মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম বেশ কমেছে। জুলাই মাসে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ১২ শতাংশ। আর পাম অয়েলের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। আগের মাসের তুলনায় চিনির দাম কমেছে ৪ শতাংশ। থাইল্যান্ডের চালের (৫% ভাঙা) দাম কমেছে ৬ শতাংশ।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত