সুদ মওকুফে কঠোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন জারি

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা সমঝোতার মাধ্যমে একে অন্যের সুদ মওকুফ করে দিচ্ছেন। আবার সরকারি ব্যাংকগুলো থেকেও বড় অংকের সুদ মওকুফ সুবিধা নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় এভাবে সুদ মওকুফের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ঋণগ্রহীতার মৃত্যু বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া এভাবে সুদ মওকুফ করা যাবে না। কোনোভাবেই মওকুফ করা যাবে না ব্যাংকের মূল ঋণ। আবার জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফ করা যাবে না। ব্যাংকের আয় খাত বিকলন করে সুদ মওকুফ করা যাবে না। ঋণের সুদ মওকুফ সুবিধা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। তবে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূল ঋণের সুদ মওকুফ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণ করা যাবে।
সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় আদায় নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তহবিল ব্যয় আদায়-সংক্রান্ত শর্ত শিথিলের সুযোগও রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে—এমন প্রকল্পের ক্ষেত্রে তহবিল ব্যয় আদায়ের শর্ত শিথিল করা যাবে। একইভাবে ঋণের জামানত, সহজামানত, প্রকল্প সম্পত্তি এবং প্রকল্প উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করেও তহবিল ব্যয় আদায় করা সম্ভব না হলে শর্ত শিথিল করা যাবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে আইনগত ব্যবস্থাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পাওনা আদায় করা না গেলে এবং ঋণগ্রহীতার মৃত্যু অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, মড়ক, নদীভাঙন বা দুর্দশাজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা যৌক্তিক কারণে ঋণ পরিশোধে অপারগ হলে তহবিল ব্যয় আদায়ের শর্ত শিথিল করা যাবে।
তহবিল ব্যয় আদায়ের শর্ত শিথিল করার যৌক্তিকতা নিশ্চিত করতে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে হেড অব ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্সের মতামত গ্রহণ করতে হবে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেসব ঋণের ক্ষেত্রে আর্থিক বিবরণী প্রণয়নের আবশ্যকতা রয়েছে, সেসব ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে ব্যাংক আবশ্যিকভাবে ঋণগ্রহীতার বিগত তিন বছরের আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করবে। আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনায় বিবেচনাধীন সময়ের সামষ্টিক কর-পরবর্তী নিট মুনাফা অথবা সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী ওনার্স ইকুইটি ইতিবাচক পরিলক্ষিত হলে সুদ মওকুফ করা যাবে না। সুদ মওকুফ করা হলে ব্যাংকের নিজস্ব আর্থিক অবস্থার ওপর কীরূপ প্রভাব পড়বে সেটিও পর্যালোচনা করতে হবে। সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো নিজস্ব মূলধন পর্যাপ্ততা, মুনাফাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সূচক বিবেচনায় নিয়ে অধিক মাত্রায় ডিউ ডিলিজেন্স প্রয়োগ করবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা পরিপালন নিশ্চিতকরণসহ অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং তার পরিবারের সদস্যরা বা পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংক কর্তৃক সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা নির্দেশনাসহ সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে জারীকৃত নির্দেশনা পরিপালনীয় হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ খাত বা সময়ের জন্য সুদ মওকুফ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হলে সে ক্ষেত্রে ওই নির্দেশনা পরিপালনীয় হবে। জারীকৃত নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিটি ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে সুদ মওকুফ-সংক্রান্ত নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপন জারির প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকগুলো বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারে, যেমন—ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, মড়ক, নদীভাঙন, দুর্দশাজনিত কারণে বা বন্ধ প্রকল্পের ব্যাংকঋণের সুদের সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ মওকুফ করে দিতে পারে। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, এসব বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন গ্রাহকের সুদ প্রায়ই মওকুফ করে দিচ্ছে। এতে সুদ মওকুফ সুবিধা পাওয়ার জন্য গ্রাহকদের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে অনাগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে, যা ব্যাংক খাতে সার্বিক ঋণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
এজন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, সামগ্রিক ঋণশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও গ্রাহকস্বার্থ সংরক্ষণে ব্যাংক খাতে ঋণের (ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে বিনিয়োগ) আরোপিত, অনারোপিতসহ সব ধরনের সুদ (ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে মুনাফা) মওকুফের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। তবে আগের সুদ মওকুফ সুবিধা নেয়া গ্রুপের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত