হজ্ব কী ও কেন? জেনে নিন তাৎপর্য
হজ্ব মহান আল্লাহর ইবাদত। বান্দার প্রতি স্রষ্টার হক্ব। ঈমানের আলোকিত নিদর্শন। পবিত্র কুরআন ইরশাদ হয়েছে, অর্থ: মানুষের উপর আল্লাহর বিধান ঐ ঘরের হজ্ব করা, যার আছে সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য। আর কেউ কুফর করলে আল্লাহ তো বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন। সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭ সুতরাং হজ্ব আল্লাহর বিধান, আল্লাহর হক্ব। মেহেরবান আল্লাহ এ বিধান কত সহজ করে দিয়েছেন! শুধু সামর্থ্যবানদের জন্য তা ফরয। এরপর সারা জীবনে একবারমাত্র করা। বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন অর্থ: ‘হজ্ব একবার। এরপর যদি কেউ বেশি করে তা ঐচ্ছিক।’ মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১২০৪নসুতরাং সামর্থ্য থাকার পরও যে হজ্ব করে না কে আছে তার মতো বদনসীব?
উপরের আয়াতের ‘আর কেউ কুফর করলে…’ কথাটি অতি ভয়াবহ। এতে এই ইঙ্গিতও আছে যে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্ব না করা একপ্রকারের কুফর। কর্মগত কুফর তো বটেই, কারণ হজ্ব ইসলামের একটি রোকন। সুতরাং বিনা ওজরে তা পালন না করা কুফরের এক শাখা। নেক আমলগুলো যেমন ইমানের শাখা তেমনি বাদ আমল ও গুনাহের কাজগুলো কুফরের শাখা। আর কুফরের শাখা-প্রশাখায় বিচরণকারীর ইমান যে ক্ষতিগ্রস্ত তা তো বলা অপেক্ষা রাখে না।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত অর্থ: ‘হজ্বের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে হজ্ব করল না, এরপর সে ইহুদি অবস্থায় মারা যাক কি নাসরানী অবস্থায় সবই তার জন্য সমান!’ তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫৭৮।
হজ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং হজ্বের সফর একটি ইবাদতের সফর। এ নিছক ভ্রমণ বা পর্যটন নয়। ইসলামে তো ভ্রমণ-পর্যটনেরও রয়েছে আলাদা নীতি ও বিধান, যা রক্ষা করা ও পালন করা কর্তব্য। সুতরাং ইবাদতের সফরে আদব রক্ষা করা এবং প্রচলিত ভ্রমণ-পর্যটনের স্বেচ্ছাচার থেকে পবিত্র রাখা তো অতি জরুরি। এরপর যে সময়টুকু ইহরামের হালতে থাকা হয় ঐ সময়ের জন্য তো বিশেষ কুরআনী নির্দেশ। অর্থ: ‘হজ্বে কামাচার, পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদের অবকাশ নেই।’ সুরা বাকারা (২) : ১৯৭।
আর এ নির্দেশ পালনের প্রতিদান কী তা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ করেছেন অর্থ: যে আল্লাহর জন্য হজ্ব করল অতপর তাতে অশ্লীল কর্ম ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল সে ঐ দিনের মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায় যেদিন সে ভুমিষ্ট হয়েছিল। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৫০। অন্য হাদীসে এসেছে। অর্থ: মাবরূর হজ্বের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৯। মাবরূর হজ্ব ঐ হজ্ব যা শরীয়তের বিধি-বিধান অনুযায়ী গুনাহ থেকে বেঁচে আদায় করা হয়।
হজ্ব একটি ইবাদত। আর ইবাদতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাহ্। এই দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে ইসলামের ইবাদত অন্য সকল ধর্মের ইবাদত-উপাসনা থেকে আলাদা। ইবাদত একমাত্র আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা এবং যাঁর ইচ্ছায় সৃজন-বর্ধন, লয়-ক্ষয়, উপকার-অপকার। তিনিই একমাত্র উপাস্য ও মাবুদ। তিনি ছাড়া ইবাদত-উপাসনার উপযুক্ত আর কেউ নেই। এই তাওহীদই হচ্ছে জগত-স্রষ্টার শাশ্বত বিধান। এই বিধান দিয়েই তিনি যুগে যুগে নবী রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। কোরআনুল কারীমে এরশাদ হয়েছে।
অর্থ: আমি তো প্রত্যেক জাতির মাঝেই রাসূল পাঠিয়েছি (এ পয়গাম দিয়ে যে,) তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগূতকে বর্জন কর। সুরা নাহল (১৬) : ৩৬। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে: অর্থাৎ আপনার আগে আমি যে রাসূলই পাঠিয়েছি তাঁর প্রতি এই ওহী করেছি যে, আমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। সুতরাং আমার ইবাদত কর। সূরা আম্বিয়া (২১) : ২৫। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও এ বিধান দিয়েই পাঠানো হয়েছে এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে।
সুতরাং ‘তাওহীদ’ ও ‘ইত্তিবায়ে রাসূল’ এ দুই হচ্ছে আসমানী দ্বীন তথা স্রষ্টাকর্তৃক প্রেরিত ধর্মের প্রাণসত্তা এবং স্রষ্টার ইবাদত-উপাসনা ও সকল ধর্ম-কর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সূরা মুলকে ইরশাদ হয়েছে অর্থ: যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম। সূরা মুলক (৬৭) : ২। পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহ বান্দাদের থেকে ‘উত্তম’ আমল চান। আর উত্তম আমল তা-ই যা তাঁর প্রেরিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক সম্পন্ন হয়। মনগড়া পদ্ধতির ধর্ম-কর্ম তা পরিমাণে যতই হোক এবং যতই ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ হোক আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এ দুই মৌলিক বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে কত জাতি ও সম্প্রদায়ের ইবাদত-উপাসনা ব্যর্থ হয়ে গেল! কত অশ্রæ, কত ভক্তি, কত ত্যাগ-তিতিক্ষা, সবই অসার, অর্থহীন, শিরক-বিদআতের কারণে, যা সৃষ্টিকর্তার মহা-অবমাননা ও চরম অবাধ্যতা। তো এই ভক্তি, এই সমর্পণ-বিসর্জন কীভাবে তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? মহান আল্লাহ আপন দয়ায় যাদের ইমান নসীব করেছেন তাদের কর্তব্য, ইবাদতের স্বরূপ সঠিকভাবে উপলব্ধি করা এবং ইবাদতের গুণ ও প্রাণ রক্ষার সর্বোত্তম চেষ্টা করা যেন কোনোভাবেই তাতে শিরক-বিদআতের মিশ্রণ না ঘটে যায়, আর কোনো প্রকারেই তা সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত না হয়।
আর হজ্বের সকল কাজ যেন সুন্নাহ্ মোতাবিক হয় এজন্য প্রয়োজন ইলমের। আর তা হাসিল হয় আলিমগণের সান্নিধ্যে। এজন্য হজ্বের আগে ও হজ্বের সফরে হক্কানী আলিমের সান্নিধ্য গ্রহণ এবং হজ্বের আদব ও মাসায়িলের চর্চা আবশ্যক। হজ্বের মূল্যবান সময় অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় না করে ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনী ইলম অর্জনে মশগুল থাকা কর্তব্য। এভাবে আমাদের হজ্ব, যা এক মহান ইবাদত ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রোকন, সু-সম্পন্ন হওয়ার আশা করা যায়। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন! আমীন।
লেখক: তরুণ আলেমেদ্বীন ও ইসলামী চিন্তাবিদ, নগরকান্দা, ফরিদপুর।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত