২৫০ বাসের মালিক এনা পরিবহণের এনায়েতুল্লাহর গল্প

| আপডেট :  ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৩:৩৩  | প্রকাশিত :  ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৩:২৯

এনা পরিবহনের যাত্রা ১৯৮৪ সালে। মাত্র একটি বাস দিয়ে। ঢাকার মিরপুর-গুলিস্তান রুটে চলাচল করত বাসটি। বর্তমানে লোকাল রুট ছাড়িয়ে আন্তঃজেলা বাস চলাচলের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি হয়ে উঠেছে এনা পরিবহন। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় এখন আড়াইশর মতো বাস রয়েছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ।

এনা পরিবহনের ব্যবসা সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে গত সাত বছরে। ২০১৩ সালের আগেও এনা পরিবহনের ব্যবসা ছিল মূলত ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটকেন্দ্রিক। পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, ওই সময় কোম্পানির বহরে বাসের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের আশপাশে। সে হিসেবে গত সাত বছরে এনা পরিবহনের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে অন্তত চার-পাঁচ গুণ।

গত কয়েক বছরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের গণ্ডি পেরিয়ে এনা পরিবহনের ব্যবসা ছড়িয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, বিয়ানীবাজার, রংপুর, বুড়িমারী, পঞ্চগড়সহ দেশের দূরপাল্লার প্রায় সব রুটে। সাধারণ চেয়ার কোচ নিয়ে ব্যবসা শুরু করা কোম্পানির বহরে যুক্ত হয়েছে হুন্দাই, স্ক্যানিয়া, ভলভোর মতো অত্যাধুনিক সব বাস। বর্তমানে প্রতিদিনই ঢাকার মহাখালী টার্মিনালের বড় একটি অংশ থাকছে এনা পরিবহনের মালিকানাধীন বাসের দখলে।

এনা পরিবহনকে এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ পরিবহন কোম্পানি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বিষয়টি মানতে রাজি নন কোম্পানির মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে আমি পরিবহন ব্যবসায় আছি। ব্যবসার অভিজ্ঞতার কথা যদি বলি, তাহলে এ সময়টা খারাপ ছিল না। বর্তমানে আমার কোম্পানির আড়াইশর মতো বাস রয়েছে। এ রকম বহর নিয়ে আরো অনেক কোম্পানিই বর্তমানে ব্যবসা করছে। কাজেই এনা পরিবহনকে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পরিবহন কোম্পানি বলা যায় না।

তবে কোম্পানির বাসের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, সারা দেশে বর্তমানে যেসব রুটে এনা পরিবহনের বাস চলাচল করছে, সেসব রুটে নিয়মিত কার্যক্রম বজায় রাখতে হলে বহরে আরো বেশিসংখ্যক বাসের প্রয়োজন পড়ে।

গত সাত বছরে এনা পরিবহনের বাসের সংখ্যা যে গতিতে বেড়েছে, একই গতিতে খন্দকার এনায়েতুল্লাহর সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে পরিবহন খাত থেকে প্রতিদিন ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যদিও খন্দকার এনায়েতুল্লাহ শুরু থেকেই বলছেন, অভিযোগটি ষড়যন্ত্রমূলক।

মাত্র একটি বাস দিয়ে যাত্রা করা এনা পরিবহনের উত্থানের গল্পটি জানতে পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ও প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলা হয়। তারা জানিয়েছেন, ১৯৮৪ সালে ঢাকার মিরপুর-গুলিস্তান রুটে যাত্রা করে এনা পরিবহন। খন্দকার এনায়েতুল্লাহর উত্থান ঘটে নব্বইয়ের দশকে। সে সময় তিনি প্রথমবারের মতো ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন। ওই সময় সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের তত্কালীন মেয়র মির্জা আব্বাস। সংগঠনের প্রভাবে এনা পরিবহনের ব্যবসা বাড়ে। লোকাল রুট ছেড়ে আন্তঃজেলা বাস চলাচলে নাম লেখায় এনা পরিবহন। ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত ব্যবসাটি ছিল মূলত ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটকেন্দ্রিক।

এনায়েতুল্লাহর উত্থান সম্পর্কে দেশের শীর্ষ একটি পরিবহন কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে হরতাল-অবরোধসহ দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি মারাত্মক রকম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এ অস্থিতিশীলতার মধ্যেও খন্দকার এনায়েতুল্লাহর নেতৃত্বে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কাজ করেন পরিবহন নেতারা। অবরোধে বাস চালিয়ে ক্ষতির মুখেও পড়েন খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। আগুনে পুড়ে যায় এনা পরিবহনের বেশ কয়েকটি বাস। ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতার সুনজরে আসেন তিনি। এরপর তাকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বর্তমানে খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব। সর্বশেষ গত ২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সংগঠনটির কাউন্সিলে দুই বছরের জন্য একই পদে দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। আর গত বছর পেয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের পরিবহন খাতের বিভিন্ন ইস্যুতে বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছেন ঢাকা ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। সড়ক আইন সংশোধনের দাবি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবিসহ অনেক ইস্যুতেই তিনি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে মালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘট, কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিগুলোতেও জোরালো ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

দীর্ঘদিন ধরে পরিবহন খাতের নেতৃত্বের সুযোগে খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দুদক বর্তমানে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে। এ নিয়ে গত ১৪ জুন তার সম্পদের হিসাব চেয়ে এনায়েতুল্লাকে নোটিস পাঠায় সংস্থাটি। দুদকের নোটিসের পর সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ও তার পোষ্যদের সম্পদের নথিপত্র চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি ব্যাংকসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি ব্যাংক, ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিআরটিএ চেয়ারম্যান, নিবন্ধন অধিদপ্তর, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাক বিভাগ, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ পাঁচ সিটি করপোরেশন, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজার পৌরসভা এবং জাতীয় গৃহায়ণ অধিদপ্তরসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে দেয়া চিঠিতে এনায়েতুল্লাহ, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের নামে থাকা হিসাব বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চাওয়া হয়েছে।

দুদকের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদক যে কারো সম্পদের হিসাব চাইতেই পারে। বিষয়টি আমি ইতিবাচকভাবে দেখেছি এবং এরই মধ্যে আমার সম্পদের হিসাব দুদকে জমাও দিয়েছি।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, পুরোপুরি ভুয়া একটি অভিযোগ করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার প্রতিপক্ষের কেউ অভিযোগটি করেছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।

সূত্র: বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত