৯ মাস ধরে বেতন পান না ৬১ শিক্ষক
দীর্ঘ নয় মাস ধরে বেতন-ভাতা ও বোনাস পাচ্ছেন না দিনাজপুর আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অনার্সের নন-এমপিওভুক্ত ৬১ শিক্ষক ও পাঁচ জন কর্মচারী। বারবার বলার পরও শিক্ষকদের বেতন দিচ্ছেন না অধ্যক্ষ। দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তারা বেতন-ভাতা ও বোনাস থেকে বঞ্চিত। এ নিয়ে সোমবার (১১ এপ্রিল) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কলেজের অধ্যক্ষ ড. সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমানকে নিজ কক্ষে অবরুদ্ধ করেন ৬১ শিক্ষক। এ সময় বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবি জানান শিক্ষক-কর্মচারীরা। একপর্যায়ে সেখানে হট্টগোল শুরু হয়। চার ঘণ্টা পর বেতন-ভাতা পরিশোধের আশ্বাসে মুক্ত হন অধ্যক্ষ।
শিক্ষকরা বলছেন, বেতন-ভাতা পরিশোধ না করলে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে তালা দেবেন তারা।
শিক্ষকরা জানান, দীর্ঘ নয় মাস বেতন আটকে রেখেছেন অধ্যক্ষ। বেতন-ভাতার বিষয়টি সমাধানের জন্য একাধিকবার বললেও সমাধান করেননি অধ্যক্ষ। ক্ষুব্ধ হয়ে আজ তাকে অবরুদ্ধ করেছেন শিক্ষকরা।
দিনাজপুর অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জুলাই মাস থেকে বেতন পাননি দিনাজপুর আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের ৬১ শিক্ষক এবং পাঁচ কর্মচারী। এরমধ্যে দুই কর্মচারী বেতন না পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বেতনের পাশাপাশি গত বছর বৈশাখী বোনাস ও পূজার দুটি বোনাস দেওয়া হয়নি তাদের।
কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি সাজমিন সুলতানা বলেন, ‘বেতন না পাওয়ায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছি আমরা। আগের অধ্যক্ষের সময়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মাসের ১ তারিখে বেতন দেওয়া হবে। এই কলেজে ২০০৮ সাল থেকে চাকরি করছি। কখনও বেতন বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। গত বছর কলেজের সাধারণ হিসাব এবং অনার্স হিসাব এক জায়গায় করা হয়। তখন থেকে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বেতন না পাওয়ায় করোনাকালীন কীভাবে চলছি, তা কেবল আমরাই জানি। বেতন বন্ধ থাকায় প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ নিয়েছি, তা পরিশোধ করতে পারিনি। রমজান মাস, সামনে ঈদ। এখনও যদি এভাবে চলে কীভাবে আমাদের সংসার চলবে।’
কলেজের শিক্ষক রূপা রানী দাস বলেন, ‘আমাদের সব অভিযোগ অধ্যক্ষের চেয়ারের বিরুদ্ধে। তবে আমাদের সঙ্গে অধ্যক্ষের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। জানি না কেন ওই চেয়ারে বসে আমাদের বেতন-ভাতা নিয়ে টালবাহানা করছেন অধ্যক্ষ। বেতন যতবার চেয়েছি ততবারই তিনি বলেছেন, ফান্ডে টাকা নেই। কিন্তু করোনার সময়ও তো শিক্ষার্থীদের বেতন ঠিকই নেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, সেসব টাকা গেলো কোথায়?’
কলেজের প্রভাষক মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘দীর্ঘ নয় মাস ধরে আমাদের বেতন বন্ধ। শুধু বেতন নয়, দুই বছর ধরে কোনও বোনাস পাইনি। অধ্যক্ষের কাছে বারবার গিয়েও কোনও সমাধান হয়নি। তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন। এর আগে মার্চ মাসে বেতন দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েও বাস্তবায়ন করছেন না। এক প্রকার স্বেচ্ছাচারিতা করছেন।
বেতন না পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কর্মচারী রিপন চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘বেতনের সমস্যার কারণে তিন মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। বেতন সবসময় ভেঙে ভেঙে দিয়েছিল। এক মাসে দিতো অর্ধেক, পরের মাসে দিতো না। দুই মাস পর দিতো অর্ধেক। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ বেতন বন্ধ হয়ে গেলো। গত নয় মাস ধরে বেতন বন্ধ। এজন্য চাকরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছি। শুধু আমি নই, বেতন না পেয়ে আমার সহকর্মী গৌতমও চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ ড. সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নয় মাসের বেতন-ভাতা বন্ধ আছে। গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। কারণ, গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাধারণ হিসাব এবং অনার্স হিসাব এক জায়গায় করা হয়েছে। বোনাসের বিষয়টি আমাদের নীতিমালায় ছিল না। তাছাড়া প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে। বর্তমানে জেলা প্রশাসক কলেজের সভাপতি। কিন্তু তিনি ব্যস্ত থাকেন। এজন্য সময় দিতে পারছেন না।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন দিতে প্রতি মাসে ১৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়। করোনার কারণে অর্থনৈতিক সংকট রয়েছে। কলেজের প্রায় ২৪ থেকে ২৫ খাত থেকে আয় হয়। কিন্তু একমাত্র টিউশন খাত থেকে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার কথা রয়েছে। অন্য খাত থেকে দিলে গভর্নিং বডির অনুমতির প্রয়োজন হয়। এর আগে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নিং বডির সভায় অন্য খাত থেকে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই মোতাবেক চেক পাঠানো হয় কলেজের সভাপতি ডিসির কাছে। কিন্তু ওই চেক আটকে যায়। শিক্ষকরা বেতন না পাওয়ায় তাদের মাঝে অস্থিরতা বেড়েছে। বেতনের বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি আমরা।’
কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকী বলেন, ‘নিয়ম রয়েছে এক খাত থেকে অন্য খাতে অর্থ ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু বেতন দেওয়ার খাতে অল্প কিছু টাকা আছে। এ অবস্থায় অন্য খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রেজুলেশন স্বাক্ষর হওয়ার পরই বেতন-ভাতা পাবেন তারা। কলেজের পুরো হিসাবটি দেখার জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আসলে ঘটনাটি কি সেটা জানা জরুরি। আমি তো সবেমাত্র এলাম, পুরো বিষয়টি জানা নেই। কমিটির প্রতিবেদন এলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কলেজের ইন্টারনাল অডিট দেখা হবে। আমরা চাই কলেজটি যেন ভালো করে পরিচালনা হয়।’
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত