কর্মচারীদের পদোন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে
প্রশাসনে গতি আনার কথা বলে পদ বিলুপ্ত ও নতুন করে পদ সৃষ্টির কাজ শুরু করেছে সরকার। সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্ত করে উপসচিবের পদ বাড়ানো হচ্ছে। নতুন বিধানে সিনিয়র সহকারী সচিবকে সরিয়ে শাখার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে উপসচিবকে। সাংগঠনিক কাঠামো হালনাগাদ করার নামে পদ বিলুপ্ত করতে গিয়ে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা এ তথ্য জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দাপ্তরিক কাজে গতি আনার জন্য মাঠ প্রশাসন শাখার যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গতি আনা ছাড়াও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় জোরদার করাও এ কমিটির অন্যতম উদ্দেশ্য। কমিটি বৈঠক করে এসব বিষয়ে সুপারিশ করছে। কমিটির সুপারিশ আমলে নিয়ে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে সব মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুবিভাগ, অধিশাখা ও শাখা পুনর্বিন্যাস, বৃদ্ধি বা বিলুপ্তির তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব বিলুপ্তি বা বৃদ্ধির তথ্য গত ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জনপ্রশাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ তাদের পরিকল্পনার তথ্য জনপ্রশাসনে পাঠিয়েছে। বিভাগটির পদ সৃজন ও বিলুপ্তির প্রস্তাব নিয়ে বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনের দপ্তরে। বেলা ১১টায় এ বৈঠক অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করা হলেও অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা পেছানো হয়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ আইন বিভাগে অতিরিক্ত সচিবের পদ দুটি। তা ৫টি বাড়িয়ে মোট ৭টি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যুগ্ম সচিবের ৪টি পদ। ১১টি বাড়িয়ে যুগ্ম সচিবের ১৫টি পদ করা হচ্ছে। উপসচিবের পদ ১৩টি। দ্বিগুণের বেশি ২৭টি বাড়িয়ে উপসচিব করা হচ্ছে ৪০টি। উপপ্রধানের ১টি পদ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিবের ২৯টি এবং সিনিয়র সহকারী প্রধানের ৯টি পদ বিলুপ্ত করা হচ্ছে। ১০ গ্রেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তার ১০টি পদ বাড়িয়ে ৩৯টি, ব্যক্তিগত কর্মকর্তার ২টি পদ বাড়িয়ে ২৩টি করা হচ্ছে। এ ছাড়া অডিটর পদ সৃষ্টি হবে ৪টি, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ৯টি পদ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে না থাকলেও ডেচপাচ রাইডার ২টি, গাড়িচালকের ৬টি পদ সৃজন করা হচ্ছে। ২০তম গ্রেডের ৪৩ জন অফিস সহায়ক থাকলেও আরও ২৩টি পদ সৃষ্টি হচ্ছে।
আজকের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের বিদ্যমান অর্গানোগ্রাম হালনাগাদ, অতিরিক্ত সচিবের ৫টি, যুগ্ম সচিবের ১১টি, উপসচিবের ২৭টি নতুন পদ সৃষ্টি, উপপ্রধানের ১টি, সিনিয়র সহকারী সচিবের ১১টি, সিনিয়র সহকারী প্রধানের ৯টিসহ ৩৯টি পদ বিলুপ্তি করার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া নন-ক্যাডারের অন্যান্য পদে সংযোজন-বিয়োজন করা হবে।
সিনিয়র সহকারী সচিব পদটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকেন্দ্রিক। মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাইরে পদটি সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে পরিচিত। এ কারণে সিনিয়র সহকারী সচিব পদটি বিলুপ্ত করলে নতুন পদের প্রয়োজন নেই। কারণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শাখা অফিসার হতে হলে উপসচিব হতে হবে।
গতিশীলতা আনয়ন কমিটির ৭ জুলাইয়ের বৈঠকে সব মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগের সংখ্যা নির্ধারণ করে অনুবিভাগ প্রধান হিসেবে যুগ্ম সচিবের বদলে অতিরিক্ত সচিব করার সুপারিশ করা হয়। অধিশাখা ও শাখা পর্যায়ে কর্মকর্তা পদায়নে রুলস অব বিজনেস সংশোধনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করারও সুপারিশ করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শাখা পর্যায়ের সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্ত করে উপসচিব পদায়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি কার্যকর করা হলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের (পিও) পদোন্নতি বন্ধ হবে। এতে সচিবালয়ে কর্মরত প্রায় ২ হাজার প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাসহ অন্যান্য পদের আরও প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী পদোন্নতিবঞ্চিত হবেন। পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হলে হতাশার কারণে কর্মস্পৃহা নষ্ট হবে। কর্মকর্তারা সংস্কারের নামে পদ বিলুপ্ত করে কর্মচারীদের বিক্ষুব্ধ করতে পারেন না। বিষয়টি আমরা শীর্ষ পর্যায়েও জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন দপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের মোট পদের এক-তৃতীয়াংশ পদ নিয়মিত পদোন্নতির জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। পুলিশের পরিদর্শক হতে সহকারী পুলিশ সুপার, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিদর্শক হতে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে সহকারী সচিব, অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার হতে সহকারী কর কমিশনার, উপ-সহকারী প্রকৌশলী হতে সহকারী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির সুযোগ রয়েছে। সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্ত হলে এসব পদোন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে শিগগিরই দেখা করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্ত না করে আমাদের পদোন্নতির পথ খোলা রাখার জন্য অনুরোধ জানাব।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন প্রস্তাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদ যদিও বাড়ছে, কিন্তু তাদের পদোন্নতির কোনো রূপরেখা নেই। পদোন্নতির বিষয়টিও এখানে বিবেচনায় আনতে হবে।
শুধু স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ নয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগও পদ সৃজন ও বিলুপ্তির প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সহকারী পুলিশ সুপার পদের ১০৮টি পদ বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমানে পুলিশে ক্যাডার পদের সংখ্যা ৩ হাজার ১২৩ জন। এর মধ্যে এএসপি পদ ১ হাজার ৩৮০টি। ৬ হাজার ৮৯৬ জন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) এএসপি পদের একটি অংশ পূরণ করেন পদোন্নতির মাধ্যমে। এএসপি পদ বিলুপ্ত হলে ইন্সপেক্টররা পদোন্নতি পাবেন না।
একাধিক পুলিশ ইন্সপেক্টর বলেন, নিম্ন পর্যায়ের পদ বিলুপ্ত করে উচ্চ পর্যায়ে নতুন পদ সৃষ্টির বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত