গ্রাম থেকে শহরের স্কুলে চলে আসার হিড়িক প্রাথমিক শিক্ষকদের

| আপডেট :  ১২ অক্টোবর ২০২২, ০৪:০১  | প্রকাশিত :  ১২ অক্টোবর ২০২২, ০৪:০১

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনলাইন বদলি চালু হলেও শর্তের মারপ্যাঁচে আবেদনের সুযোগ পাননি বেশিরভাগ শিক্ষক। যাঁরা আবেদনের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের বেশিরভাগই যেতে চান শহরাঞ্চল, পৌরসভার ভেতরে বা আশপাশের বিদ্যালয়ে। উপজেলা সদর অথবা যোগাযোগব্যবস্থা ভালো এমন বিদ্যালয়ে যেতে আবেদন বেশি করেছেন নারী শিক্ষকরা।

সারাদেশে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক আছেন চার লাখের মতো। তাঁদের মধ্য থেকে বদলির জন্য প্রায় ২৬ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, বদলি নীতিমালায় কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়ায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষক আবেদন করতে পারেননি। অতীতে কখনও এমন হয়নি।

তিন বছর পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইনে নেওয়া হয় বদলির আবেদন। প্রথম দফায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন নেওয়া হয়। এরপর সময় বাড়ানো হয় ৬ অক্টোবর পর্যন্ত। এবার আবেদন কম পড়লেও সময় আর বাড়ানো হবে না বলে সমকালকে জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত। তিনি বলেন, নির্ধারিত সফটওয়্যারে আবেদনগুলো প্রক্রিয়া করে ফল ঘোষণা করা হবে। শিক্ষকদের শহরের বিদ্যালয়গুলোতে আসার প্রবণতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটাই স্বাভাবিক। আপনি-আমি হলেও সেটাই করতাম।’

জানা যায়, নোয়াখালী সদর উপজেলার ১৯৮টির মধ্যে পদ খালি আছে শতাধিক বিদ্যালয়ে। এ উপজেলায় ৫২৯ শিক্ষক বদলি হতে আবেদন করেছেন মাত্র ২০টি বিদ্যালয়ের জন্য। শর্তের জটিলতাকেই এর জন্য দায়ী করেছেন বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকরা। জেলা শহরের অরুনচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি শূন্য পদে বদলি হয়ে আসতে আবেদন করেছেন ৭৭ জন। এক বিদ্যালয়ের জন্য এত আবেদন দেখে হতবাক শিক্ষকরাই। কেউ শহরের স্থায়ী ঠিকানায়, নারী শিক্ষকদের কেউ কেউ স্বামীর চাকরির স্থানে বদলি চেয়ে পৌর শহরের ভেতরের স্কুলগুলোর জন্য আবেদন করেছেন।
ঢাকাসহ দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি (সিটি করপোরেশনের বাইরে থেকে) বন্ধ থাকায় আশপাশের পৌরসভা বা উপজেলা সদরের এক থেকে দুটি বিদ্যালয়ে বদলির জন্য আবেদনের হিড়িক পড়েছে।

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় বদলির আবেদন জমা পড়েছে ৩১টি। এর মধ্যে পৌরসভা এলাকার কচুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শূন্য পদের বিপরীতে ২৩টি আবেদন পড়েছে। পৌরসভা বা জেলা সদরে আবেদন বেশি পড়লেও অনেক উপজেলায় আবেদন খুবই কম। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় ১৬৫টি বিদ্যালয় থাকলেও বদলির আবেদন ৩৮টি। বদলি নীতিমালায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ :৪০ শর্তের কারণে এই উপজেলার অনেক শিক্ষক আবেদন করতে পারেননি।

নির্দিষ্ট কিছু বিদ্যালয়ে বদলির আবেদন অত্যধিক জমা পড়লেও সারাদেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি বিদ্যালয়ে মোট আবেদন পড়েছে ২৫ হাজার ৭৩২টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলায় আবেদন ৪ হাজার ৫৫৮টি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে শিক্ষক আছেন ৭২ হাজার ৮১৫ জন। এই বিভাগের ৯৪ শতাংশ শিক্ষকের বদলির আবেদন করার সুযোগ হয়নি। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় বিদ্যালয় আছে ১২২টি এবং শিক্ষক আছেন ৭৪৮ জন। উপজেলায় প্রধান শিক্ষকের ২৪টি এবং সহকারী শিক্ষকের ৭৮টি পদ খালি আছে। এসব পদে বদলির জন্য আবেদন পড়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে লতিফপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে আবেদন পড়েছে চারটি।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় প্রধান শিক্ষকের ৩১টি ও সহকারী শিক্ষকের ৫৫টি পদ শূন্য। এ উপজেলার আবেদনের সঠিক সংখ্যা জানাতে অস্বীকৃতি জানান ভারপ্রাপ্ত উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে এখানে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে রুদ্রগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসার জন্য। ঝালকাঠি সদরে সহকারী শিক্ষকের ৩৯টি ও প্রধান শিক্ষকের ৩০টি শূন্য পদে যেতে আবেদন করেছেন ৬৫ শিক্ষক। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ ৩২টি। তবে আদালতে মামলার কারণে ১৯টি পদে কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। বাকি ১৩টি শূন্য পদে আবেদন করেছেন সাতজন। এ উপজেলায় সহকারী শিক্ষকের ২০টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২০ জন। এর মধ্যে কিছু বিদ্যালয়ে একাধিক আবেদন পড়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শিক্ষকদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব, স্থায়ী ঠিকানা, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত এবং স্বামী বা স্ত্রীর কর্মস্থল- এসব বিষয়ে স্কোরিং করে বেশি স্কোর অর্জনকারী শিক্ষকের বদলির আবেদনপত্র সফটওয়্যারে গৃহীত হবে।

তবে বদলি নীতিমালা সহজ করার দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষকরা। নোয়াখালী সদরের অরুণ চন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবেদনকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, এত শিক্ষক আবেদন করবেন জানলে এখানে আবেদনই করতেন না। কর্তৃপক্ষের উচিত আবেদন করার সময় সফটওয়্যারে অটো নির্দেশনা দেওয়া- কোন স্কুলে কতজন আবেদন করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে স্কোরটাও সংশ্নিষ্ট শিক্ষককে জানিয়ে দেওয়া। তাহলে একটি শূন্য পদে অনেক আবেদন জমা পড়বে না। এ ছাড়া একজন শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ে বদলি হওয়ার পরই তাঁর শূন্য পদে আবেদনের সুযোগ রাখা প্রয়োজন। তাহলে কখনও শিক্ষক সংকট থাকবে না। পাশাপাশি প্রতিস্থাপন, নিয়োগ সাপেক্ষে বদলি এবং পারস্পরিক বদলির সুযোগ নীতিমালায় রাখতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত এসব বিষয়ে সমকালকে বলেন, এবার মূলত আন্তঃউপজেলা বদলির আবেদন নেওয়া হয়েছে। এতে আবেদন কিছু কম হতে পারে। নীতিমালা সংশোধনের বিষয়ে শিক্ষকদের দাবি প্রসঙ্গে মহাপরিচালক কোনো মন্তব্য করেননি।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত