প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শীতকালীন অবকাশ এবং কিছু কথা

| আপডেট :  ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:১২  | প্রকাশিত :  ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:১২

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে শিক্ষকরা যতদিন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষক হতে না পারবেন ততদিন শিক্ষা থাকবে আমলাদের হাতে। শিক্ষক থাকবেন অনুগত দাস।সমস্যার তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। সমাধান করব কি না সে সিদ্ধান্ত কে নেবে?

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা আমাদের দেশের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো। তারা সমন্বয় ছাড়া সারা বছরই রাস্তা খুঁড়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য একটা প্রজ্ঞাপন বিভাগ আলাদাভাবে তৈরি হওয়া উচিত। রাত নেই, দিন নেই, সময় অসময় নেই প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে যখন তখন। নাম ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট। ছুটির বিশাল তালিকা। সেখানে যে জাতীয় দিবসগুলোতে নির্ধারিত সময়ের চেয়েও বেশি সময় থাকতে হয় সে দিবসও ছুটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।

দীর্ঘ সময় করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকলেও বিস্কুট বিতরণ, উপবৃত্তি, নানা হিসাবনিকাশ দিতে স্কুলে বিভিন্ন সময় যেতে হয়েছে শিক্ষকদের। মাঝামাঝি সময়ে এসে ফোনে, অন লাইনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে শিক্ষকদের অনির্ধারিত সময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু সমাজে শিক্ষকদের অপদস্ত করা এবং অসম্মান করার এক নতুন সংস্কৃতি চালু হওয়ায় ‘শিক্ষকরা বসে বসে বেতন নেয়’ এই কথা প্রচলিত রয়েছে। নানা সময়ে, নানা মিটিংয়ে পর্যন্ত কর্মকর্তারাও বলেছেন, বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। যে শিক্ষা একটা জাতিকে শিক্ষককে সম্মান দিতে শিখায় না সে জাতির শিক্ষা সনদনির্ভরই হয়।

বাসায় একটা সন্তান সামলাতেই যাদের নাভিশ্বাস উঠে তারা কি একবার ভেবে দেখবেন, এই যে শত শত শিশুকে দিনের দীর্ঘ সময় শিক্ষকরা নিজেদের শাসন, ভালোবাসায় রেখে শিক্ষা দেন তা কতটা কষ্টসাধ্য কাজ। জানি, বলবেন, এজন্য তো বেতন দেয়া হয়। বেতন দিয়ে মা, বাবা আর শিক্ষকের শ্রম যে কেনা যায় না সেটা বুঝবার ক্ষমতা এ জাতির নেই।

এসএসসি পাস ডাটা এন্ট্রির চাকরি করেন যিনি তার বেতন স্কেল দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার সমকক্ষ। অথচ স্নাতকোত্তর প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন স্কেল ড্রাইভারের সমকক্ষ। এ জাতিকে দয়া করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা দান করেন সেটা অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলেই বুঝতে পারবেন।

অবশ্য শিক্ষকরা যুগের পর যুগ এই দয়াটা যে এ জাতিকে করছেন সেটা বুঝবার জন্য শিক্ষক শব্দ এবং তার গুরুত্ব জাতির আগে বুঝতে হবে।

ভ্যাকেশন শব্দের অর্থ ছুটি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই ভ্যাশনাল ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী। তবে, এই ছুটি মারেফতি ছুটি। এই গোপন ছুটির অর্থ সবার বোধগম্য হবে না। ছুটির তালিকায় লেখা- শীতকালীন অবকাশ এবং যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যালয় বন্ধ।

ইতোপূর্বে শীতকালীন অবকাশ এতদিন ছিল না। এবার পরীক্ষা নেই, খাতা দেখার ঝামেলা নেই। নানা ধরনের তালিকা তৈরিও নেই। ফলে এত বড় বন্ধ নিয়ে বড় বড় পরিকল্পনা ছিল শিক্ষকদের। গত চার মাস যাবত সারা দিনব্যাপী বিদ্যালয়ে থাকা, নানা ধরনের অসুস্থতা, আত্মীয়স্বজনের মৃতু্য বিভিন্ন কারণে মানসিকভাবে নানা অস্থিরতায় কেটেছে সময়।

ছুটির তালিকার সঙ্গে সমন্বয় রেখেই তৈরি হয় একজন চাকরিজীবী মানুষের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের কর্ম পরিকল্পনা।

যে শিক্ষক তার পরিবারকে নানা দিবসে সময় দিতে পারে না সে এই ছুটির তালিকা অনুযায়ী গ্রামে, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে অথবা কোথাও সন্তানসহ ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। কেউ কেউ বাস/ট্রেনের টিকিটও কেটেছে।

আত্মীয়স্বজন তাদের শিক্ষক আত্মীয়র ছুটির সঙ্গে মিল রেখে বিয়ে, সুন্নতে খতনা অথবা অন্য কোনো উৎসবের তারিখ ঠিক করেছেন।

নিজের অসুস্থতা বা পরিবারের অন্য কারো অসুস্থতার অপারেশন বা চিকিৎসার তারিখ এই ছুটির তারিখের সঙ্গে মিল রেখেই নির্ধারণ করা হয়েছে।

সরকারি কর্মচারী চব্বিশ ঘণ্টাই সরকারের কাজ করতে বাধ্য। জরুরি পরিস্থিতিতে ছুটি বাতিল করার ক্ষমতা সরকার রাখে। প্রশ্ন হলো, দেশে কি জরুরি অবস্থা চলছে?

ছুটির তালিকায় প্রকাশিত ছুটি কেন ছুটির আগের দিন বাতিল করা হলো সে কারণ জানার অধিকার কি শিক্ষকদের নেই?

কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বড় বড় মাথা নিয়োগ রয়েছে এ দেশের নানা ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণে। যদিও মাঝে মাঝে আমরা দেখি, খিচুড়ি রান্না, পুকুর কাটা, কলা গাছ লাগানোসহ নানা কাজের প্রশিক্ষণের জন্য এই মাথাদের বিদেশে যাওয়ার মহোৎসব। এবার কি ছুটি শব্দের প্রকৃত অর্থ জানার জন্য এবং ছুটি বাতিলের সময়, কারণ কীভাবে নির্ধারণ করতে হয় তা শিখবার জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিদেশে পাঠাতে হবে?

গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, বারো ভাতারী ঘর। প্রশাসনের যেসব ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কারণে নানা দুর্ভোগের শিকার হয় মানুষ তাদের জন্যই এই প্রবাদের প্রচলন।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল ছিল না প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মের ছুটির। ফলে, যে পরিবারে দুই বিদ্যালয়েরই সন্তান ছিল সেসব পরিবারকে নানা সমস্যায় পড়তে হতো এই দুই সময়ের ছুটি নিয়ে। এ ব্যাপারে বহু লেখালেখি করেছি। প্রস্তাবাকারে তৎকালীন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা জিন্নাত আলী বিশ্বাস আমার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ছুটির সমন্বয়ে চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছিলেন। অবশেষে দুই স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির সমন্বয় হয়েছিল।

মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের জীবন, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় নেই বলেই ছুটি নিয়ে এ ধরনের প্রহসন করা যায়। উচ্চবিত্ত বুঝবেই না হঠাৎ বাতিল হওয়া এই ছুটি কতটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করল কারো কারো জীবনে।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভর্তি শুরু হয়ে গেছে মাধ্যমিকে। অন্যান্য শ্রেণিকে আগেই বন্ধ দেয়া হয়েছে। বেড়াতে চলে গেছে শিক্ষার্থীরা নানা জায়গায়। হুট করে এই সিদ্ধান্তে কী অর্জন হলো? শিক্ষা বিপস্নব ঘটাতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ইতিহাস হবে এবার।

কয়েক দিন যাবতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোনা যাচ্ছিল কয়েকটি উপজেলায় ছুটি বাতিল হয়েছে। একই ডিপার্টমেন্টে একটা ছুটির খবর এক সপ্তাহ আগে থেকে চার লাখ শিক্ষকের মাঝে মাত্র কয়েক শত শিক্ষক জানল আর বাকিরা জানল ছুটি যেদিন থেকে শুরু হওয়ার কথা তার কয়েক ঘণ্টা আগে। কেন?

এই কেনটা জানতে চাইবার কথা শিক্ষক সংগঠনের। এই ধরনের হয়রানি তুলে ধরার কথা মিডিয়ার। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাবার কথা শিক্ষকের। মিডিয়া আর শিক্ষক সংগঠন যখন নীরব তখন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষক হিসেবে আমি এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেই সংগে প্রশাসনের কাছে বিনীতভাবে জানতে চাইছি, যেসব দিবস পালনের জন্য শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে অবস্থান করেন, সে দিবসগুলো কেন ছুটি হিসেবে তালিকাভুক্ত হবে?

স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষকদের অর্জন ঘুষিতে শিক্ষকের দাঁত ফেলে দেওয়া, লাথিতে হাসপাতালে পাঠানো, পিটিয়ে ঠ্যাঙ ভেঙে দেওয়া।

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে শিক্ষকরা যতদিন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষক হতে না পারবেন ততদিন শিক্ষা থাকবে আমলাদের হাতে। শিক্ষক থাকবেন অনুগত দাস। সমস্যার তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। সমাধান করব কি না সে সিদ্ধান্ত কে নেবে?

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক।
সম্পাদনায়: উজ্জ্বল প্রধান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত