যারা হামলার শিকার তারাই মামলার আসামী

১০ই সেপ্টেম্বর। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয় থেকে রিকশাযোগে বাসায় ফিরছিলেন ছাত্রদল নেতা আরিফুল ইসলাম, আশিকুর রহমান ও আতিকুর রহমান। রিকশা দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছলে পেছন থেকে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে গুরুতর আহত হন তিন জনই।
আরিফুল কদমতলী থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক, আশিক যুগ্ম আহ্বায়ক আর আতিক একই থানার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। শুরুতে একটি মাইক্রোবাস থেকে নেমে কয়েকজন তাদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। সেখান থেকে কোনোমতে স্থানীয় একটি হাসপাতালে যায় তারা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় শুনতে পান তাদের পরিবারের লোকজন থানায় মামলা করতে গেলে উল্টো নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা জানায় পুলিশ।
পরে বেসকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আরিফ আর আতিক বাসায় ফিরলেও এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরিফ। শুক্রবার দুপুরে ছাত্রদল নেতা আরিফুল ইসলাম ও আশিকুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তাদের অভিযোগ, যারা হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা তদন্ত না করে উল্টো যারা এই ঘটনার কিছুই জানেন না তাদের আসামি করা হয়েছে।
এমনকি আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রশাসন এবং সরকারিদলের লোকেরা বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এই মামলা ভিত্তিহীন এবং বিএনপি নেতাদের ফাঁসাতেই এমন মামলা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কদমতলী থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, গত ১০ই সেপ্টেম্বর দুপুরে পার্টি অফিসে আমাদের একটা প্রস্তুতি সভা ছিল। আমরা সেখানে বেশ কয়েকজন ছিলাম। সভা শেষ করে বাসায় যাওয়ার জন্য আমরা দু’টি রিকশা নিই। আমি, আশিক আর আতিক এক রিকশায় উঠি। বাকিরা ছিল অন্য রিকশায়। তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুর হলেও রাস্তায় তেমন মানুষ ছিল না। টিকাটুলী তিন রাস্তার মোড় পার হয়ে দয়াগঞ্জের দিকে যাওয়ার সময় আমাদের রিকশা ঢুকতেই পেছন দিয়ে হামলা চালানো হয়। এসব জায়গায় সব সময় পুলিশের টহল দল বা ট্রফিক পুলিশ থাকলেও সেদিন কাউকে দেখিনি। প্রথমে বুঝতে পারিনি যে, আমাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর দেখি সারাশরীর রক্তে ভিজে গেছে।
তখন রিকশা চালককে বললাম দ্রুত চালানোর জন্য। এই অবস্থায় হামলাকারীরা ছিনতাইকারি বলে আমাদের ওপর হামলা করছিল। রিকশা কিছুদূর যাওয়ার পর হামলাকারীরা আমাদের চারপাশে ঘিরে ফেলে। আমাদের উল্টা-পাল্টা ছুরিকাঘাত করতে থাকে। পরে আমরা দৌড় দেই। কিছুদূর গিয়ে আরেকটা রিকশায় উঠি। রিকশা নিয়ে কোনোমতে দয়াগঞ্জে ইব্নে সিনা হাসপাতালের সামনে গেলে রিকশা থেকে পড়ে যায় আশিক। পরে আমি হাসপাতালে গিয়ে বললাম আমাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা আমাদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলে। পরে পাশের একটি হাসপাতালে গেলে তারাও চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তখন বাকি তিনজন যে আরেক রিকশায় ছিল তারা খবর পেয়ে এখানে আসে। সেখান থেকে সিএনজিতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে আমাদের। রাত সাড়ে ১১টার দিকে খবর পাই এই ঘটনায় পুলিশ উল্টো আমাদের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর আমরা হাসপাতাল ত্যাগ করি। পরে অন্য একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। বাসায় ফিরলেও আমি এখনো অনেক অসুস্থ। চলাফেরা করতে পারছি না।
তিনি বলেন, এই ঘটনায় যাদের আসামি করে মামলা করেছে এর পুরোটা ভিত্তিহীন। কারণ আমরা যাদের সঙ্গে রাজনীতি করি, যারা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের টার্গেট করে মামলা করা হয়েছে। গুরুতর আহত আশিকুর রহমান বলেন, ‘তোরা বিএনপি করিস’- এই কথা বলেই আমাদের হামলা করা হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের ভালোভাবে চিনতে পারিনি। ওইদিন অন্য বন্ধুরা যদি আমাদের হাসপাতালে নিয়ে না যেতো আজকে হয়তো বেঁচে থাকতাম না। এই ঘটনায় আমার বাবা থানায় গিয়েছিলেন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করতে। কিন্তু পুলিশ তাদের মতো করে আসামির নাম বসিয়ে এজাহার লিখে স্বাক্ষর করতে বলেন। তখন আসামিদের নাম দেখে বাবা স্বাক্ষর না করে থানা থেকে চলে আসেন।
আশিক বলেন, আমার পুরো পরিবার এখন আমার সঙ্গে হাসপাতালে। কেউ এখনো বাসায় যায়নি। আমরা খুবই আতঙ্কে আছি। সব সময় মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। এ ঘটনায় আশিকুর রহমানের বাবা মামলা না করলেও ওই রাতেই ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করে কদমতলী থানা পুলিশ। মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদকে। তার বাবা সালাউদ্দীন আহমদ কদমতলী-শ্যামপুর এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য। গুরুতর আহত তিনজন স্থানীয় রাজনীতিতে তানভীর আহমেদের অনুসারী।
আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও কদমতলী থানা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি মীর হোসেন, ৬১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যাত্রাবাড়ী থানা বিএনপি’র সাবেক সহ-সভাপতি জুম্মন মিয়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন, একই ওয়ার্ডে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন, ৫২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র আহ্বায়ক মো. দিপু, ৬০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র আহ্বায়ক ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, কদমতলী থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন। এছাড়া বাকি সাত আসামিও বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে ছাত্রদলের ওই তিন নেতার সঙ্গে মামলার আসামিদের নয়াপল্টনের বিএনপি’র কার্যালয়ে কথাকাটাকাটি হয়। ছাত্রদল নেতারা দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ডের মূল ফটকের সামনে দিয়ে রিকশা করে যাওয়ার সময় ঢাকা মহানগর বিএনপি’র নেতারা (মামলার আসামিরা) ধারালো চাকু ও রড দিয়ে তাদের রক্তাক্ত করেন। বিএনপি নেতাদের হামলায় ছাত্রদলের নেতারা গুরুতর আহত হলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন বিএনপি নেতারা চলে যান।
মামলায় এক নম্বর আসামি বিএনপি নেতা তানভীর আহমেদ বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সবকিছু জেনেছে। তারপরেও আমিসহ আমার সহযোদ্ধাদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আড়াল করতে এবং বিএনপি নেতাদের ফাঁসাতে মূলত এই মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত