যে বুদ্ধি খাটিয়ে মার্কিন নাগরিকের আইফোন ফেরত দিলেন রিকশাচালক আমিনুল

রাজধানীর গুলশান এলাকায় আট বছর ধরে রিকশা চালান আমিনুল ইসলাম। সম্প্রতি তার রিকশায় একটি মুঠোফোন (আইফোন ১৩ প্রো-ম্যাক্স) ফেলে যান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিক। পরে ফোনটি পেয়ে পুলিশের মাধ্যমে মালিককে ফিরিয়ে দেন তিনি। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর আলোচনায় আসেন আমিনুল।
আমিনুলের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। স্ত্রী জেসমিন আক্তারকে নিয়ে তিনি থাকেন বাড্ডা এলাকায়। তাদের সংসারে দুই সন্তান রয়েছে। অভাবের কারণে আমিনুল অষ্টম শ্রেণির পর লেখাপড়া করেননি। তবে তিনি কষ্ট করে হলেও তার দুই সন্তানকে লেখাপড়া করাতে চান। সন্তানদের নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা।
শুক্রবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে গুলশান-২ নম্বর এলাকায় আমিনুলের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, ৮ বছর ধরে গুলশান এলাকায় রিকশা চালান। গত ৫ আগস্ট গুলশান-২ নম্বর এলাকায় যাত্রী নামিয়ে দেওয়ার পর তিনি গদির ফাঁকে মোবাইলটি দেখতে পান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, রিকশা থেকে মোবাইলটি দেখে হাতে নিয়ে দেখি মোবাইলটি বন্ধ, চার্জ নেই। মোবাইল বন্ধ থাকায় যার মোবাইল তাকে ফেরত কীভাবে দেবো। মোবাইল খোলা থাকলে মালিক ফোন দিতে পারে। এই চিন্তা করে রিকশা রেখে মোবাইলটির চার্জার কিনতে যাই। দোকানে চার্জার কিনতে যেয়ে দেখি আইফোনের চার্জারের দাম ৭০০-৮০০ টাকা। দিনে আমার ইনকাম ৫০০-৬০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে চার্জার কীভাবে কিনবো?
চার্জারের দাম বেশি চাওয়ায় পরে বুদ্ধি করে মোবাইলটি থেকে সিম খুলে আমার নিজের মোবাইলে ঢুকালাম। এর একদিন পর রাত ১১টার দিকে ওই সিমে ফোন আসে। পরদিন বাড্ডা থানায় গিয়ে যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিল সেই নম্বরসহ পুলিশের কাছে আইফোন দিয়ে আসি।
মোবাইলটি অনেক দামি। আপনি বিক্রি না করে ফেরত দিলেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে রিকশাচালক বলেন, মোবাইল পাওয়ার পর আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল যার মোবাইল তাকে ফেরত দিয়ে দেবো। মোবাইলটি ফেরত দিয়ে আমার নিজের কাছে অনেক অনেক ভালো লাগছে। পুলিশের কাছ থেকে মোবাইলের মালিক মোবাইলটি ফেরত নিয়েছে।
রিকশা চালিয়ে দুই সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছেন জানিয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, মানুষের উপকার ছাড়া জীবনে কারও ক্ষতি করিনি। অনেক কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছি। ছেলে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে আর মেয়ে পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। আমার আশা কষ্ট করে হলেও দুটি সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করবো।
তিনি বলেন, ঢাকায় থাকা-খাওয়া, লেখাপড়ার খরচ অনেক বেশি। তাই সন্তানদের গ্রামে রেখেছি। তিনি প্রতি মাসে সেখানে খরচের টাকা পাঠিয়ে দেই। আমি গরিব। সংসারে অভাব আছে। কিন্তু অন্যের সম্পদের ওপর আমার কোনো লোভ নেই। সততা নিয়েই বাঁচতে চাই।
এদিকে, মোবাইল ফেরত দেওয়ার ঘটনায় আমিনুল ইসলামকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এ প্রসঙ্গে আমিনুল বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। শুনে খুশি হয়েছি। তবে পুরস্কার বড় বিষয় নয়। মানুষের উপকার করতে পারাটাই আমার কাছে আসল কাজ বলে মনে হয়েছে।
মোবাইলের মালিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সীমা আহম্মেদ জানান, মোবাইলটি তার ছেলে স্যামি আহম্মেদের। তারা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। সেদিন তিনি ছেলেকে নিয়ে রিকশায় করে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন। পথে মোবাইলটি হারিয়ে যায়। মোবাইলে চার্জ ছিল না। তাই কলও করা যাচ্ছিল না। পরে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। একপর্যায়ে সিম চালু পান। ফোন করলে এক রিকশাচালক ধরেন। তিনি মোবাইলটি পাওয়ার কথা জানান। মোবাইলটি নিয়ে যেতে বলেন। তারা পুলিশকে এ তথ্য জানান। পরে আমিনুল পুলিশের কাছে মোবাইলটি পৌঁছে দেন।
গুলশান থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আবদুল কাদির বলেন, রিকশা থেকে মার্কিন নাগরিকের অসাবধানতাবশত আইফোনটি পড়ে যায়। পরে তিনি গুলশান থানায় জিডি করেন। মোবাইলটিতে রোবট তৈরির একটি প্রকল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ছিল। রিকশাচালক আমিনুল মোবাইলটি পেয়ে সততার সঙ্গে ফেরত দিয়েছেন।
এএসআই আরও বলেন, প্রায় সাত বছরে সাড়ে চার হাজার মোবাইল উদ্ধার করেছি। কিন্তু কখনোই এমন সততার দৃষ্টান্ত দেখিনি। আমাদের সবার আমিনুলের কাছ থেকে শেখা উচিত।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত